প্রায় চার যুগ থেকে কিচেনে বন্দী। যাবজ্জীবনই বলা চলে! একজন মানুষের জীবনের দুই তৃতীয়াংশ সময় যখন কিচেনে কাটে তখন তাকে কি বলা যায়? ৩৮ বছর থেকে কিচেনে কাজ করছেন শেফ নজরুল ইসলাম। বন্দী জীবনের শুরুর দিকে দুই সপ্তাহ পরেই পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নি। বাবা পালাতে দেন নি, বললেন টাকা পয়সা রোজগার করো তার পরে দেখা যাবে। পালাবেনই না কেন। ফুরফুরে কাপড় চোপড় পরে ঘুরাঘুরি। কোন কাজ করতে হয়না। তারুণ্যের কি আয়েসি জীবন! পারিবারিক সূত্রে যখন বাবার সাথে বাংলাদেশ ছেড়ে বিলেত আসেন তখন কয়েক দিন ঘুরাফিরার পরে প্রথম কাজ রেষ্টুরেন্টে। তাও কিচেন পোর্টারের হার্ড জব। কথাগুলো এই প্রতিবেদককে বলছিলেন বিগলসওয়েড শহরের বিগলস লাঞ্জের শেফ নজরুল ইসলাম। এখন আর এ নিয়ে কোন অনুতাপ নেই। এই বন্দী জীবনকেই ভালবেসে নিয়েছেন। সহসাই এর থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই অর্থাৎ অবসরে যাবেন এ কথাও ভাবছেন না।
শেফ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ১৯৮২ সালে যুক্তরাজ্যে আসেন। কর্মজীবনের শুরুতে যে পেশার প্রতি আগ্রহ ছিলনা, অর্থাৎ মানুষের জন্য খাবার তৈরী, সে পেশাই এখন তার জীবন। মিল্টন কীনস এর বিকাশ রেষ্টুরেন্টে কিচেন পোর্টারের একটি পদ খালি আছে। অত্যন্ত ব্যস্ত একটি রেষ্টুরেন্ট। কাস্টমারদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। কিচেনে পোর্টারের কাজে তখন ইতোমধ্যেই কাজ করছেন। আগেকার দিনে তো আর এখনকার মতো ডিশওয়াশার মেশিন ছিলোনা। তাই ৩ নম্বর কিচেন পোর্টারের পদ দিয়ে তাকে নিয়োগ করেন রেষ্টুরেন্টের মালিক আব্দুল মতিন। আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় নিয়োগ দেয়ার পরে রেষ্টুরেন্টের হেড শেফকে তিনি বলেন, নজরুল ইসলামকে যেন তিনি কাজ শেখান। ব্রিটিশ কারি ইন্ডাষ্ট্রীতে আজকে যারা নামী দামী শেফ কর্মরত রয়েছেন তাদের সবারই ট্রেনিং ‘অন দ্যা জব’। অর্থাৎ প্রশিক্ষণটা কাজের মধ্যেই হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়েই তারা এই পর্যায়ে পৌছেছেন। কোন কালিনারি স্কুলে তারা যাননি। এভাবেই গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ কারি ইন্ডাষ্ট্রী। সে যাক, নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
নজরুলেরতো আর কাজে মন বসে না। আর কত ওয়াশিং আপ করবেন? ২/৩ সপ্তাহ পরে বাবাকে বলেন, আর ভাল লাগেনা। তিনি দেশে ফিরে যেতে চান। বাবা তখন বলেন, আগে কিছু টাকা পয়সা রোজগার করো তারপরে দেশে যাওয়া যাবে। সেই শুরু। ধীরে ধীরে কিচেন পোর্টার থেকে উপরের দিকে ওঠতে থাকেন। খাবারের প্রতি আগ্রহ জাগতে থাকে। শেফও তার প্রতি মনোযোগি হন। দায়িত্বও বাড়তে থাকে। মোটামুটি একজন দক্ষ কুকে পরিণত হন, তিনি। টানা চার বছর কাজ করেন বিকাশ রেষ্টুরেন্টে। যখন কুক হিসাবে তার আস্থা পোক্ত হলো তখন তিনি কর্মস্থল পরিবর্তনের চিন্তা করেন। চাকরির অফার পান ব্রাইটনে অবস্থিত একটি ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে। সেখানে কিছু দিন কাজ করার পর তার কাজের অফার আসে লন্ডনের হ্যামারস্মীথের আনারকলি রেষ্টুরেন্টে। আনারকলি খুবই বিজি অর্থাৎ ব্যস্ত এবং সেসময়কার একটি জনপ্রিয় ব্যবসা সফল রেষ্টুরেন্ট। নতুন তান্দুরী শেফ হিসাবে যোগ দেন নজরুল ইসলাম। নজরুল বলেন, একজন দক্ষ শেফ হিসাবে পরিণত হওয়ার পেছনের ইতিহাস হচ্ছে আমি জীবনে কোন কম বিজি রেষ্টুরেন্টে কাজ করি নাই।
নজরুলের খাবার কি কাস্টমার ভালবাসেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে একটু থমকে গেলেন তিনি। বললেন, কাস্টমারের প্লেট এবং কারির পাত্র যখন ফেরত আসে তখন আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন, তারা ভালবাসেন কিনা। আর খাবার যদি ভাল না হয় তখন দেখবেন এম্পলয়ারের কাছেও আপনার কদর নেই। অথবা এ নিয়ে আপনি একটি টেনশনে থাকবেন সব সময়। আমি একটি রেষ্টুরেন্টে কাজ করেছি ২২ বছর। ক্যাননস পার্কের ক্যানন তান্দুরীতে ৭ সদস্যের কিচেন টীমের নেতৃত্ব দেই এই সময়ে। নিজের রেষ্টুরেন্ট অথবা পার্টনার না হলে একই প্রতিষ্ঠানে ২২ বছর শেফ হিসাবে কাটানোও একটি বিরল ঘটনা। রেষ্টুরেন্ট মালিক ও কর্মীর মধ্যে সমঝোতা এবং কাস্টমার সন্তুষ্টি না থাকলে এই বন্ধন দীর্ঘদিনে ঠেকেনা। নজরুল জানান, কাজে বৈচিত্র আনার জন্যই তিনি অন্যত্র কাজ করছেন। ক্যানন তান্দুরী রেষ্টুরেন্টের মালিক এখনও তাকে ফিরিয়ে নিতে চান, তার পূর্বের স্থানে। নজরুল ইসলাম বলেন, অতীতেতো আর এরকম সোশ্যাল মিডিয়া ছিলনা। কাস্টমারদের ফিডব্যাক নেয়া হতো রেষ্টুরেন্টের কমেন্ট বুকে অথবা ওয়েটাররা জিজ্ঞেস করতেন খাবার কেমন লাগলো। একদম সরাসরি রিয়েকশন। তবে হ্যা, এখন সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি বেশি। আপনার খাবার যদি মন্দ হয় তখন শুধু আপনি জানবেন না, সারা বিশ্ব জানবে। আপনার এম্পলয়ারের কাছেও আপনার কদর থাকবেনা। সেজন্যে খাবার তৈরীতে একজন শেফের অতিরিক্ত যতœ নিতে হয়। কাস্টমার সন্তুষ্টি ও গুড রিভিউ ব্যবসার উন্নয়নে অপরিহার্য্য।
নজরুল ইসলাম বলেন, আমি সবসময়ই ফ্রেশ উপাদান ব্যবহার করি। এখনতো ফ্রেশ ভেজিটেবল ও হার্বস আরও বেশি পাওয়া যায়। আজকাল অনেকেই নিজেরাও তরি তরকারি ফলান। নজরুল ইসলাম খাবার নিয়ে সবসময়ই এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসেন। তিনি বলেন, আমি ওল্ড স্কুল শেফ হলেও নতুন কিছু তৈরীর চেষ্টা করি। পুরাতন ও নতুনের সমন্বয় ঘটিয়ে মজাদার খাবার তৈরীই আমার লক্ষ্য।
তিন সন্তানের জনক নজরুল বাসায় কি খাবার রান্না করেন? ইতস্তত করে বললেন, মাঝে মাঝে। বাসার কিচেন আমার স্ত্রীর নিজস্ব এলাকা। নজরুল অকপটে বললেন আমার স্ত্রী রহিমা বেগম আমার চেয়ে ভাল কুক। বিশেষ করে মাছ রান্নার ক্ষেত্রে। তার খাবার অনেক মজাদার। আর শুধুতো ভাত মাছই রান্না করা হয়না বাসায়, আমাদের বাঙালির ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছু বাসায় রান্না করা হয়। এজন্যে আমাদের স্ত্রীরাই সবসময় এর নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। তবে মাঝে মাঝে রেষ্টুরেন্ট থেকেও ছেলেমেয়ে পরিবারের জন্য তার রান্না করা খাবার টেকওয়ে নিয়ে যান। স্ত্রীর প্রশংসা যখন পান তখন মনে হয় তিনি সঠিক কিছু করছেন জানান শেফ নজরুল ইসলাম।
শেফ নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ৩৮ বছরের রেষ্টুরেন্ট জীবনে কখনো কি নিজে ব্যবসা করার কথা ভেবেছেন। বলেন, কার্ডিফে একটি রেষ্টুরেন্ট করেছিলেন পার্টনারশীপে। ব্যবসাও ভাল ছিল। তিনি মনে করেন, কিচেনে একজন কর্মরত শেফ হিসাবে যে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ থাকে তা অতুলনীয়। ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব অনেক। তাছাড়া পার্টনারশীপ হলে অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়। সেজন্যে শেফ হিসাবে তার কাজে ফোকাস থাকাই তিনি শ্রেষ্ট মনে করেন।
শেফ নজরুল ইসলাম বিয়ে শাদী, জন্মদিনের পার্টি অথবা আউটসাইডের ক্যাটারিংয়েও দক্ষ। কর্মক্ষেত্রে সে অভিজ্ঞতাও তিনি অর্জন করেছেন। তার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করলে, একটু থেমে নজরুল ইসলাম বললেন… ক্যাননস পার্কে কাজ করাকালীন সময়ে একটি পার্টিতে দুই হাজার মানুষের খাবার তৈরি করেছি। এই পর্যায়ের একটি পার্টিতে খাবার তৈরিতে যোগ দিয়ে যখন প্রশংসা পেয়েছি সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।
বর্তমান কর্মক্ষেত্রে প্রায় দুই বছর থেকে কাজ করছেন শেফ নজরুল ইসলাম। তার কিচেনে একটি দক্ষ কর্মীবাহিনী রয়েছে। তাদের সবার প্রশংসা করেন নজরুল। বলেন, টীম ভাল না থাকলে অগ্রসর হওয়া যায়না। আর আমার টীমের সবাই এ ব্যাপারে পারফেক্ট।
বিগলস লাঞ্জ রেষ্টুরেন্ট এর পার্টনার শহীদুল ইসলাম নিটন শেফ নজরুল সম্পর্কে বলেন, ঐব রং ধ মবস. অর্থাৎ একজন রতন হচ্ছেন তিনি।