কত নমুনার পদ আছে সিলেটিরা খায়,
সিলেটোর খানি কত কইতাম,কওয়ার শেষ নায়।
বেটাগিরি কম নায়়, হখলবায়ও আছে
খেলাধূলা, পড়াশুনা,
গান-কীর্তন নাচে।
তবে খানির বায়়ও দেখি এক ধাপ আউগাইয়া।
জুইত মতন খানি অইলে মন যায়় ভরিয়া
কত পদ খাইছি হাতে ঠাকুমার দিদিমার।
ইতা সব ফালাইয়া যুগর লগে নাচিয়ার
ছড়াটা পড়তে গিয়েই বুঝতে পারছেন, ভাষাটা বাংলা হলেও ঠিক বাংলার মত নয়, একটু আলাদা। সিলেট ঠিক তেমনি, মানচিত্রে বাংলাদেশের অংশ হলেও ভাষা আর খাদ্যাভ্যাসে ভারতের উত্তর-পূর্বের আসাম-মনিপুর অঞ্চলের সঙ্গেই যেন একটু বেশি মিল! হবেই না বা কেন? ১৯৪৭ সালে, গণভোটের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে পূর্ববঙ্গে যোগ দেবার আগে সিলেট তো ছিল আসামেরই অংশ।
এ কারণেই বাংলাদেশের একদম উত্তর পূবের টিলাময় চা-বাগান, ঝরণা, হাওড় সমৃদ্ধ এই জনপদের বাসিন্দাদের খাদ্যাভাসের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের খাবারের খানিকটা অমিল। হাওড়ের টাটকা মাছ আর পাহাড়ি লেবু জাতীয় টক ফলের রসায়নে জন্ম নিয়েছে উপাদেয় সব পদ, তেমনি হযরত শাহজালাল (রঃ) ও তাঁর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার আগমণের মাধ্যমে সিলেটবাসীদের খাদ্যাভাসে যুক্ত হয়েছে মধ্য এশিয়ার প্রভাব। সিলেট থেকে বিলেতে পাড়ি জমানো প্রবাসীরাও জন্ম দিয়েছেন নতুন এক ধরণের খাদ্যরসনার। সুরমা পাড়ের স্বাদ তাই স্বকীয় এবং অনন্য।
বাংলা সাহিত্যে স্বাদু গদ্য লিখিয়েদের ভেতর সৈয়দ মুজতবা আলীর তুলনীয় খুব কম লেখকই আছেন। সরেস, মজাদার, উপভোগ্য এবং পরিমিত তার লেখনি। ঠিক যেন পছন্দসই কোন খাবার! তিনি যে ভোজনরসিক ছিলেন, তার প্রমাণ আছে লেখনীর ছত্রে ছত্রে। কাবুলিওয়ালার সঙ্গে দস্তরখানে, নীল নদের পারের ক্যাফের আড্ডা থেকে প্যারিসের অভিজাত রেস্তোরা, সর্বত্রই তার সাবলীল বিচরণ। বরেন্য এই লেখক জন্মেছিলেন বরাক উপত্যকায়। রাডক্লিফ লাইন তার জন্মস্থান করিমগঞ্জকে বাংলাদেশের বাইরে ঠেলে দিলেও সিলেটের মানুষেরা করিমগঞ্জকে শ্রীহট্টের অংশ বলেই মনে করেন। সীমানা রেখা পাঞ্জাবকে ভাগ করলেও যেমন পাঞ্জাবী রসনাকে আলাদা করতে পারেনি, ব্রিটিশদের এঁকে যাওয়া সীমারেখা এখানেও সিলেটকে ভাঙতে ব্যর্থ। আর কী আশ্চর্য্য, খোদ ইংল্যান্ডের বুকেই এখন সিলেটি রসনার জয় জয়কার!
দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে যারাই বেড়াতে আসেন, ফেরার পথে তাদের সঙ্গী হয় নিকোবিনা কোম্পানির সাতকড়ার আচারের একটি বয়াম। সিলেটি রসনার প্রতীক হয়ে উঠেছে সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংসের পদটি। কাঁচা সাতকড়া বেছে কেনা, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাত করণের ঝামেলা এড়াতেই পর্যটকরা কিনে নেন সাতকড়ার আচার। আর অবশ্য গন্তব্য হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজারের আশেপাশে বেশিরভাগ দোকানেই এই আচার সুলভ বলে কিনতেও ভুল হয় না! একটু ঝাল করে গরুর মাংসের ভুনা রান্নার শেষ দিকে সাতকড়ার আচার মিশিয়ে দিলে বেশ একটা ঘ্রাণ হয়, সেই সঙ্গে মাংসের ঝোলে যোগ হয় একটা মৃদু তেতো ভাব যা মাংসের স্বাদ বাড়িয়ে তোলে। তবে সিলেটের পাকা গৃহিণীরা কিন্তু ভুলেও ওপথ মাড়ান না! বয়ামবন্দী আচারের চাইতে টাটকা সাতকড়া দিয়েই তারা তৈরি করেন মাংসের এই পদটি।
বাতাবীলেবু আকৃতির একটি লেবুজাতীয় ফল সাতকড়া, যা সিলেট, মেঘালয় ও আসাম অঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলেই জন্মায়। সেই সাতকড়া কেনাতেও বাড়ির কর্তাকে দিতে হবে মুনশীয়ানার পরিচয়। বেছে বেছে কম তেতো ও সুন্দর ঘ্রাণযুক্ত সাতকড়া না কিনলে যে সবটাই মাটি! তবে গৃহিণীর অভিজ্ঞতাও কম মূল্যবান নয়। সাতকড়া কাটার পর চেখে বুঝতে হয় কতটা তেতো, শুধু তাই নয় রান্নায় মেশাতেও হয় সময় মত। খুব বেশিক্ষণ জ্বালে রাখলে পুরো রান্নাটাই হয়ে যাবে তেতো, আবার খুব অল্প সময়ের জন্য রান্না হলে ঘ্রাণটা ঠিকমত বেরোবে না। এই জটিল হিসেব কষেই মাংস কষিয়ে রাঁধতে হবে সাতকড়া দিয়ে।
সাতকড়া দিয়ে মাংস রান্নাটাই যদিও বহুল পরিচিত, তবে সিলেটি রসনায় মাছের সঙ্গে সাতকড়া খাওয়াটাও স্থানীয়ভাবে অনেক বেশি প্রচলিত। ছোট মাছ, কিংবা বড় মাছের কাটাকুটো বা মাথার অংশ দিয়ে সাতকড়ার টক ঝোল দুপুরের খাবারে শেষ পদ হিসেবে সিলেটিদের কাছে খুবই উপাদেয়। স্থানীয় ভাষায় যা পরিচিত ‘ট্যাঙ্গা’ বা ‘খাট্টা’ নামে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ জায়গাতেই ভাত তরকারির পর শেষ পর্বে ডাল খাওয়া হলেও সিলেটে ডালের বদলে মাছের এই টক ঝোল খুবই সমাদৃত। ট্যাঙ্গা বা খাট্টা রান্নায় সাতকড়া ছাড়াও ব্যবহ্যত হয় আদালেবু ও তৈকর। এই দুটোই আসাম অঞ্চলের নিজস্ব টকজাতীয় ফল, যার উৎপাদন হয় সিলেটের পাহাড়ি টিলায়। আদালেবু ও তৈকর সাধারণত সাতকড়ার চেয়ে আকারে খানিকটা ছোট হয়। নানান ঔষধী ও ভেষজ গুণসম্পন্ন এই সব লেবুজাতীয় ফল মাছ রান্নাতেই বেশি ব্যবহ্যত হয়। ছোট ছোট করে কেটে মলাঢেলা জাতীয় ছোট মাছের মাখা ঝোল কিংবা টক ঝোল রান্নায় আদালেবু ও তৈকর যোগ করে বাড়তি স্বাদ। বিশেষ করে গরমের দিনে তেল মশলাযুক্ত খাবারের বদলে মাছের টক শরীরে আনে প্রশান্তি।
আখনির বর্ণনা বাদ দিয়ে সিলেটি রসনার গল্প বলা আর বিরিয়ানী থেকে মাংস বাদ দেয়া যেন একই কথা। আপাতদৃষ্টিতে সিলেটের আখনির সঙ্গে ঢাকাই তেহারির কোন অমিল খুঁজে না পাওয়া গেলেও স্বাদে ও রন্ধনশৈলীতে অনেকটাই আলাদা। আখনি রান্না করা হয় তেজপাতা, দারচিনি, লবঙ্গ ও নানান মশলায় সুবাসিত পানিতে। ফুটে ওঠা পানিতে রেশমি কাপড়ের ভেতর নানান মশলার পুঁটুলি বানিয়ে ছেড়া দেয়া হয়। পানি কমে আসলে কিংবা মশলার নির্যাস পানিতে মিশে গেলে সেই পুঁটলিটা তুলে নেয়া হয় কিংবা পানিটা ছেঁকে নেয়া হয়। তারপর সেই পানি দিয়েই হয় আখনি। গরু, খাসি বা মুরগির মাংস ছোট ছোট টুকরো করে পোলাউর চাল (চিনিগুঁড়া বা কালিজিরা) দিয়ে রান্না হয় আখনি। তাতে মেশানো হয় মটর, গাজর ও আলু। ইফতারের নেমন্তন্নে আখনি তো রীতিমত অপরিহার্য। ছোলা ভাজা বা স্থানীয় ভাবে ‘চানা ভুনা’র সঙ্গে আখনি ও পেঁয়াজু না হলে তো সিলেটিদের ইফতারই জমবে না! রোজার দিনগুলো ছাড়াও অতিথি আপ্যায়নে, বিশেষ ধর্মীয় দিন বা মৃত্যুবার্ষিকীতে (আঞ্চলিক ভাষায় শিন্নি) তোবারক হিসেবেও আখনি খাওয়ানো হয়।
সিলেটবাসীর ঘরোয়া ইফতারে “বড় বাপের পোলায় খায়” নামের উদ্ভট বারোভাজার কোন কারবার নেই। কালিজিরা চালের পাতলা জাউ খিচুড়িতে মেথির ফোঁড়ন দেয়া, এটাই থাকে মূল আয়োজনে। সঙ্গে নানান রকমের ভাজাভুজি তো থাকেই, আর থাকে বাকরখানি। এই বাকরখানি অবশ্য ঢাকাই বাকরখানির মত মুচমুচে আর তন্দুরে সেঁকা নয়, দেখতে অনেকটা টানা পরোটার মত আর খেতে একটু মিস্টি মিস্টি। ভাজা ছোলা বা চানাভুনার সঙ্গে খেতে অনবদ্য, দুধ চায়ে চুবিয়ে খেতেও অসাধারণ!
ইয়েমেন থেকে এসেছিলেন হযরত শাহজালাল (রঃ), তার সঙ্গে এসেছিলেন আরও ৩৬০ আউলিয়া। যারা থেকে গিয়েছিলেন পূণ্যভূমি সিলেটেই। ধারণা করা হয়, তাদের সঙ্গেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই রন্ধন প্রণালী আসে সিলেট অঞ্চলে। এমনই আরেকটি খাবার ময়দার হালুয়া যা ‘তুশা সিন্নি’ নামেও আঞ্চলিক ভাবে পরিচিত। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গাতেই বুটের ডালের হালুয়া, বেশনের হালুয়া, সুজির হালুয়া তৈরি করা হয়। মূলত শবে বরাতের সময়ই হালুয়া তৈরির প্রচলন। তবে ময়দার হালুয়া বা তুশা সিন্নি সিলেটের বাইরে খুবই কম প্রচলিত। ‘হালুয়া’ খাদ্য রীতিটাই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া থেকে। নানান অঞ্চলে ও ভাষার বিবর্তনে হেলভা, হালভা, আলুভা নামের যে খাদ্য প্রস্তুত প্রণালী, সেটাই হালুয়া। মূলনীতিটা হচ্ছে শষ্যদানার গুড়ো বা ফলের নরম অংশকে ঘি বা তেলে ভেজে চিনির প্রলেপ দিয়ে সংরক্ষণ করা। সিলেট অঞ্চলে শবে বরাতে মসজিদে মসজিদে শিন্নি বিতরণ বা আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠানো রুটি হালুয়ার তশতরীতে তুশা সিন্নি থাকবেই। গরম পানিতে তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ দিয়ে ফুটিয়ে তাতে চিনি ঢেলে তৈরি করতে হবে সুগন্ধি ‘সিরা’। তারপর আটা বা ময়দা ঘিয়ে ভেজে চিনির সিরা ঢেলে নেড়ে নেড়ে তৈরি করা হয় তুশা শিন্নি। তারপর মেশানো হয় কিশমিশ, বাদাম ইত্যাদি। সিলেটের মাজার রোডে, হযরত শাহজালাল (রঃ) এর দরগাহ’র ঠিক বাইরে হাতের দু পাশে তাকালেই দেখতে পাবেন অনেক দোকানেই টিলার মত ছোট ছোট স্তুপ করে ডিশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তুশা সিন্নি। তবে ওসব না চেখে কোন সিলেটি বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আদায় করে চেখে দেখলে তবেই পাওয়া যাবে প্রকৃত স্বাদ।
বিরইন চালের ‘চুঙ্গা পিঠা’ সিলেটির আরেকটি ঐতিহ্যবাহী রান্না । ধারণা করা হয়, স্থানীয় পাহাড়ী আদিবাসীরা হাঁড়ি পাতিলের বদলে বাঁশের ভেতরেই চাল ভরে তারপর বাঁশ পুঁড়িয়ে ভেতরের চাল সেদ্ধ করে ভাত খেত। ধীরে ধীরে সেটা স্থানান্তরিত হয় সমতলের বাসিন্দাদের জীবন আচরণেও। চুঙ্গা পিঠা খেতে লাগবে ঢলু বাঁশ আর বিরইন চাল। বিরইন চাল এক ধরণের চাল, যার ভাত আঠালো। থাই রসনার ‘স্টিকি রাইস’ যার অনেকটা কাছাকাছি। বাঁশের ভেতর ভেজানো চাল ভরে বাঁশের মুখটা কলাপাতা দিয়ে বন্ধ করে হালকা আঁচে বাঁশ পোড়ানো হয়। কিছু সময় পর বাঁশ কেটে ভেতর থেকে বের করে আনা হয় আঠালো লম্বাটে ভাতের দলা, যার সঙ্গে মিশে আছে ঢলু বাঁশের ঘ্রাণ। এই চুঙ্গা পিঠা খাওয়া হয় মাছ বিরান অর্থাৎ মাছভাজা অথবা দুধ, গুড় ও নারকেলের মিশ্রনে বানানো খিরসা দিয়ে। শহুরে জীবনে অবশ্য এত আয়োজনের উপায় নেই। তাই বলে কি খাওয়া থেমে থাকবে, মোটেও না। অনেক শহুরে বাড়িতেই তাই ছুটির দিনের সকালের নাস্তাটা থাকে বিরইন চালের ভাতের সঙ্গে দুধ, কলা, নারকেল। বলতে হয় রাই শষ্যের শাক বা লাই শাকের কথাও। মণিপুরিরা বলে লেহু, তাদের সবচেয়ে প্রিয় শাক। এটাই ভারতের সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলে আর নেপালে পরিচিত গুনদ্রুক নামে। গাছ আর ফুল দেখতে সরিষা গাছের মতো, পার্থক্য হলো বড় হলে পাতাগুলো অনেক প্রশস্ত হয়ে যায়। স্বাদও কিছুটা সরিষা শাকের মতোই তবে ঝাঁঝ সরিষা থেকে অনেকগুণ বেশি। কাঁচা লাইশাক মুখে দিলে ঝাল লাগে। লাইশাক ভেজে খাওয়া যায়। ভর্তা খাওয়া যায়। আলু বেগুন বা অন্য সবজির সাথে মিলিয়ে লাবড়া বানিয়ে খাওয়া যায়। মণিপুরিরা খাবারের সাথে কাঁচা লাইশাকের কচি ডগা কামড়ে খেতে পছন্দ করে। লেহুর কচি ডগার সাথে সেদ্ধ আলু আর শুটকি মিশিয়ে তৈরি হয় মণিপুরি সালাদ সেঞ্চু। মাছের সাথে বিশেষ করে আড় বা বোয়াল মাছের সাথে লাইশাকের রান্না তুলনাহীন। লাইশাকের সঙ্গে টাকি বা শোল মাছ মিশিয়ে বানানো ভর্তার তো তুলনা নেই! লাইশাকের কথা আসলে কান টানলে মাথা আসার মতই আসবে সিলেটি নাগা মরিচের কথা। বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচ ভূত জলোকিয়ার নিকটআত্মীয় এই নাগা মরিচ। সিলেটিরা লাই শাকের ভর্তার সঙ্গে কিংবা সিদল শুটকির সঙ্গে পাতে নাগা মরিচ পেলে যে ফোয়া গ্রা, ক্যাভিয়েরও দূরে ঠেলে দেবেন, সে কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়!
চ্যাপা শুটকি বা সিদল, কারো স্বপ্ন আর কারো বা দুঃস্বপ্ন। পুঁটি মাছের পেট কেটে পরিষ্কার করে লবণ মাখিয়ে মাটির হাঁড়িতে ভরে মুখ বন্ধ করে মাটি চাপা দিয়ে দেয়া হয়। তারপর মাসদুয়েক পর বের করা হয় সেই হাঁড়ি, যার ভেতর মেলে কারো কারো কাছে সাত রাজার ধনের চেয়েও অমূল্য “হিদল”! তীব্র কটুগন্ধের জন্য অনেকেরই চক্ষুশূল এই পদার্থটি অনেকের কাছেই অত্যন্ত লোভনীয়। ধারণা করা হয় ভারতের নাগা জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই এভাবে মাছ সংরক্ষণ করার পদ্ধতিটি সমতলের বাসিন্দারা রপ্ত করে নেন। তেল মশলা ছাড়া চ্যাপা শুটকির সঙ্গে লাউপাতা, আলু, বেগুন দিয়ে রান্না করা “হুকুইন সিরা” পেলে হয়তো অনেক সিলেটবাসীই কাচ্চি বিরিয়ানীকেও দূরে ঠেলে দেবেন।
“হাঁস-বাঁশ” দিয়ে ভরপেট খেয়ে হাঁসফাঁস করার বিরল অভিজ্ঞতা পাওয়া যেতে পারে সিলেটেই। অতিথি আপ্যায়নে কচি বাঁশের কোড়লের সঙ্গে হাঁসের মাংসের সালুন খাওয়ানো রেওয়াজ আছে সিলেটে, সেইসঙ্গে আছে এই নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্পও।
পিঠাপুলির রাজ্যে সিলেটের সেরা অবদান “মেরা পিঠা”। চালের গুড়োর কাইকে হাতের চাপে ময়ান দিয়ে গোল আকৃতি দিয়ে এরপর বাষ্পে সিদ্ধ করে নেয়া হয়। সেটা গুড় বা শুটকি ভর্তা, ধনেপাতা ভর্তা দিয়ে খাওয়া যায়, আবার সংরক্ষণ করেও রাখা যায় এবং পরে কুচি কুচি করে কেটে গরম তেলে পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে ভেজেও খাওয়া যায়। চালের গুড়ো অল্প হলুদ আর লবন দিয়ে সেদ্ধ করে কাই বানিয়ে গোল করে ছোট ছোট লুচির মত বেলে ভেজে নিলেই হয়ে যাবে “নুনগড়া”। নারকেলের পুলি পিঠা সিলেটে পরিচিত “পব” নামে, যেটা রোজার ইদে অতিথি আপ্যায়নে অপরিহার্য্য!
হাওড় দিয়েছে ধান আর মাছ। পাহাড়ি টিলার ঢালে, বৃষ্টির জলে পরিপুষ্ট হয়ে অবাধে জন্মেছে লেবু জাতীয় ফল আর সুগন্ধী বাঁশ। ৩৬০ আউলিয়া আর তাদের সহচরদের কল্যাণে স্থানীয় রসনায় যুক্ত হয়েছে মধ্য এশিয়ার প্রভাব। মনিপুরি আর নাগা সম্প্রদায়ের মানুষের খাদ্যাভাসও হারিয়ে যায়নি। সব কিছুকেই সিলেটবাসী পাতে তুলে নিয়েছে পরম মমতায়। তাই তো সিলেটের রসনারভান্ডার এতটা সমৃদ্ধ।