জলের উজ্জ্বল শস্য ইলিশ

শেখ সাইফুর রহমান
 

করোনাকালে ভারত মহাসগর, বঙ্গোপসাগর থেকে সুখবর বয়ে এনেছে জলের উজ্জ্বল শস্য ইলিশ। দূষণমুক্ত থাকায় এই সময়ে তারা কেবল গায়ে গতরেই বাড়নি বরং বর্তমানে সারা বিশ্বের ইলিশের মোট উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই বাংলাদেশের। চার বছর আগে এই পরিমাণ ছিল ৬৫ শতাংশ। ইলিশ নিয়ে যখন ওপার বাংলায় হাপিত্যেশ তখন বাংলাদেশের বাজারে যেন ইলিশের বিয়ে।
বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদনের সাফল্য এখন বিশ্বের অন্যদেশের কাছে মডেল। এই সাফল্যে অনুঘটক হয়েছে মা ও জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধ করা, অভয়াশ্রম বাড়ানো ও জেলেদের সুরক্ষা প্রদান। আর এই অভয়াশ্রমের কারণে ইলিশ বাচ্চা নিয়ে সমুদ্রে চলে গেলেও আবার সেখানেই ফিরে আসছে।
বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় এই মীনসত্তম বাংলাদেশের শ্ল­াঘার প্রতীক হয়েছে বৈকি। কিন্তু সংরক্ষণের অভাব, প্রকৃত বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় ইলিশ যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি বিদেশীদের ইলিশের স্বাদে মজানোর প্রয়াসও লক্ষ্যণীয় নয়। সারা বিশ্বে স্যামন নিয়ে যত প্রগলভতা তার ছিটেফোঁটাও নেই ইলিশকে নিয়ে। কাঁটা বেশি হলেও এর স্বাদ যে অতুলনীয় সেটা কেবল বাঙালিরাই জানছে আর সেটা তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে অদ্ভূত আত্মসুখ অনুভব করছে। অবশ্য এরই মধ্যে সরকার ২৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও পরিচালনা’ প্রকল্প অনুমোদন করেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য অধিদপ্তর ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়়ানোর লক্ষ্যে (৯ ইঞ্চিরও কম লম্বা ইলিশ রক্ষা) এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমে ছয়টি অভয়ারণ্য পরিচালনা এবং প্রায়় ৩০ হাজার জেলে পরিবারকে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা, ১০ হাজার জেলেকে বৈধ জাল সরবরাহ করা এবং বিকল্প চাকরিতে ১৮ হাজারকে প্রশিক্ষণ প্রদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অতএব এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের ইলিশের উৎপাদন বাড়াবে তা ধরেই নেয়া যায়। একই সঙ্গে জলদূষণ রোধও ইলিশের উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ফলে সেদিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলেই অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশে এবার সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত ওজনেরও ইলিশ দেখা গেছে। দুই আড়াই কেজিও ধরা পড়ছে আগের তুলনায় বেশী। অনুকূল পরিবেশ বাংলাদেশের ইলিশের ওজন আর সংখ্যা যে বাড়াবে তাতে কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।
ইদানিং ফেসবুকে একটা পোস্ট নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। পশ্চিমবাংলায় ইলিশ কেটে বিক্রি নিয়ে। এ নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করছে। কারণ সেখানে ইলিশ আমদানি যথই হোক অদ্ভূত এক কারণে দাম সাধারণের সাধ্যের মধ্যে থাকছেনা বলেই তা হচ্ছে। ইলিশ নিয়ে কথা শুরু করলে আসলে শেষ হয় না। যদিও শাস্ত্রকাররা ইলিশ নয় রুই বা রোহিতকে মৎসশ্রেষ্ঠ বলে গেছে। তবু বাঙালির কাছে ইলিশই শ্রেষ্ঠ। জলের মহারাজ। ইলিশের প্রসঙ্গ আসলে এত বিষয়ের অবতারণা হয় যে বলে শেষ করা যায় না। অথচ যেটা আর অন্য কোন মাছের ক্ষেত্রে হয় না।
ভারত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ ধরার কৌশলের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলের তফাৎ নেই। কিন্তু দাদন নাম বিষয়টিও আছে উভয়দেশেই। নতুন ট্রলার নামানোর সময়েই মূলত দাদন নিয়ে থাকেন জেলেরা। নৌকা বা ট্রলারের আয়তনের উপর নির্ভর করে দাদনের পরিমাণ। আর এই টাকা এ মৌসুমে উঠে আসে না। বা শোধ করতে পারে না। কয়েক মৌসুম লাগে।
কখনো কখনো এই দাদনের ভার ও দুঃখ বয়ে বেড়াতে হয় প্রজন্মান্তরে। এমনও শোনা যায় মাছ বেশি আমদানী হলে দাদনদার বা মহাজনেরা মাছে দাম কমিয়ে দেয় যাতে দেনা শোধ করতে না পারে। ফলে অপরিশোধ্য দেনার পরিমাণ বাড়তে থাকে। আর সেই ভার গিয়ে চাপে পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে। সমানে চলতে থাকে একই ট্র্যাডিশন।

ইলশে গুঁড়ির নাচন দেখে
নাচছে ইলিশ মাছ
তখন আর কতোই বা বয়স। বাবার সঙ্গে হাটে যাচ্ছি। বিকেলের দিকে রোদ একটু পড়ে এসেছে। বেশ একটা আলোছায়ার খেলা। এরই মধ্যে বৃষ্টি। কিন্তু এ বৃষ্টি ঠিক গায়ে লাগে না। জাম আর জামরুলের পাতায় স্ফটিক বিন্দুর মতো লেগে থাকে। যেন আঠা দিয়ে মতি বসানো। চুলের ওপর পড়েও ঠিক তেমনই হয়। মনে হয় আকাশ থেকে কেউ হিরের গুঁড়ো ছড়াচ্ছে।
বাবা বললেন, জানিস এই বৃষ্টিকে কি বলে।
-কি?
-ইলশেগুঁড়ি। এই বৃষ্টির গুঁড়ো গায়ে লাগলে তবেই ইলিশ ডিম পাড়ে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ইলিশ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে। আরো বেশ কিছু কথা বললেন। যা কতক বুঝেছি তখন, কতক বুঝিনি। মনে আছে একটা ছড়ার কটা লাইন:
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
দিনে বেলায় হিম
বাবা পুরোটা ছড়াই বলেছিলেন। বলেছিলেন বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগলে ইলিশ সত্যিই উৎফুল্ল­ হয়ে ওঠে। তখন একটা শব্দ বেশ মনে ধরে ছিল। উলসে ওঠে মন।
বড় হয়ে ছড়াটা অনেকবারই পড়েছি। তবে ইলিশের নামে কেবল আমার নয়, বলার অপেক্ষা রাখে না, আপামর বাঙালির মনই উলসে ওঠে।
সেদিন বাবার আক্ষেপও ছিল, যেমন থাকে সব অতীতাশ্রয়ী সব বাঙালির। আগের মতো এখন আর ইলিশের স্বাদ হয় না। আগে ইলিশ ভাজলে সারা পাড়ায় সেই সুবাস ছড়াতো।

 

আর সেই সুখাদ্যের ঘ্রাণে সাঁড়া গাছ থেকে পেতিœ নেমে এসে নাকি সুরে ইলিশের টুকরো চাইতো। বদলে তাকে নোড়া পুড়িয়ে স্যাঁকা দিলে সে পড়ি মড়ি করে পালাত। পথের পাঁচালির অপুর মতো হাঁ করে মায়ের কাছে এসব গল্প শুনতে শুনতেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা।
কয়েক বছর আগে এক মৎসজীবীর সঙ্গে ইলিশ নিয়ে কথা হচ্ছিল। বহু বছরের অভিজ্ঞতা। সেসব বলতে বলতে তাঁর চোখেমুখে অদ্ভূত তৃপ্তির আভা দৃষ্টিগোচর হয়। যুবতী ইলিশেরা পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোর আকর্ষণে নদীর জলের উপরিভাগে উঠে আসে। তাদের ঠাটবাটও বেজায়। দেখতেও সুন্দর পুরুষের চেয়ে। স্টাইল আর গ্ল­্যামারে পুরুষ ইলিশ ধারে কাছেও নেই।
একবার বরিশাল যাওয়ার পথে বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ সত্যিই দেখার সৌভাগ্য হয়। সেটা ছিল পুর্ণিমা। মাঝরাতে কেবিন থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়াতেই দেখি জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আর জেলেদের জালে ভরা তাল তাল রুপো। পানি থেকে টেনে নৌকায় তুলছে।
মাঝিরা জানে ইলিশের মতি গতি। কিছুদিন আগে সুপ্রতিম কর্মকারের একটা লেখা পড়ছিলাম ইলিশ নিয়ে। জেলেদের বরাত দিয়ে তিনি লিখেছেন, ইলিশের দল ঝাঁক বেঁধে যখন যায় তখন পানি ঘোলাটে হয়ে যায়। তখন সেই পানি থেকে এক ধরণের গন্ধ ছড়ায়। একে বলা হয় গন্ধঝাঁক।
জেলেরা পানির তল মেপে বুঝতে পারেন। পানির রঙ দেখে বুঝতে পারেন। আর গন্ধ শুঁকেও। এগুলো বাবার কাছেও শুনেছি। সেদিন এই বিষয় নিয়ে আমার এক সমকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনিও একই গল্প শোনালেন। এই জলের নানা রঙ, নানা নাম। তা দেখেই বলা যায় ইলিশের ঝাঁক আসছে, নাকি চলে গেছে।

পরিযায়ী ও স্বাধীনচেতা
ইলিশ কিন্তু ভীষণই স্বাধীনচেতা। অকূল পাথারেই তার বিচরণ। তাই তো সমুদ্রে থাকতেই সে পছন্দ করে। কিন্তু সংসার-সন্তানের টানও তো আছে। সেজন্যই বছরের নির্দিস্ট সময়ে ফিরে আসে নদীতে। উপভোগ করে পরিযায়ী জীবন। সমুদ্রের লোনা পানিতে নষ্ট হয় ডিম। ফলে মিঠা পানিতে এসেই ডিম ছাড়ে। এই আসাই বেশিরভাগ সময়ে কাল হয়। জেলেদের জালবন্দী হয়েছে তাদের জীবনে যতি পড়ে। এই যে তাদের উজানে আসা সেটাও কৌলিন্যের পরিচায়ক। ইলিশ কখনো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায় না। তাই তো স্রোতের বিপরীতেই চলে। এর সাঁতার অনেকটা টর্পেডোর মতো। শরীরটাও তো তেমন। ঘন্টায় গতি ৬০ কিলোমিটার পর্যন্তও হয়ে থাকে। এ নিয়ে একটা ছড়াও আছে: ঝড়ের চেয়েও বেগবতী/ পেটে ডিম ভরা ইলিশের গতি।
নদীতে এসে ডিম পাড়ার পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। সেই বাচ্চা কিছুটা বড় করে আবার ফিরে যায় বৃহৎ জগতে। পরিযায়ী পাখীদের মতো ইলিশও দলবদ্ধভাবে চলে। পুরুষ মাছ উপরের দিকে থাকে। নারী মাছ নীচের সারি চলে। ফেরার সময় মাঝে থাকে বাচ্চারা।
ইলিশ নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। বিশেষত এদের খাবার নিয়ে। মড়া খাওয়ার কথা প্রায়শই শোনা যায়। যদিও তা একেবারেই ভুল। ইলিশ নিরামিশাষী। পানির সবুজ শেওলাই এদের মূল খাদ্য। কোন নোংরা এরা স্পর্শ করে না।

যতনাম
কতকিছুরই তো কত না হয়। নানা নামে পরিচিতি পায়। কাজেই জলের মহারাজের নানা নাম হবে তাতে আর আশ্চর্য কি। এই যেমন আমরাই ডাকি কতো নামে। ইলিশ, চন্দনা, জাটকা, খয়রা; চট্টগ্রামের দিকে বলে চিটা। কুমিল্ল­া নোয়াখালিতে আবার বিল্লি, খাল্লিশ, বাম পাইটে, সকড়ি। নদী থেকে বিলে এসে কুল হারানো ইলিশ হয়ে যায় বিলিশ। উড়িষ্যার মানুষ বলে ইলিশি। আসামে সেটা আবার হিলসা। বিহারে বলে ইলসা। গুজরাটে স্ত্রী আর পুরুষ ইলিশকে পৃথক নামে ডাকা হয়। স্ত্রী মাছ মদেন আর পুরুষ মাছ পালওয়া। এই গুজরাটি ইলিশকে সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন বলেছেন ঘাসের মতো। কোন স্বাদ নেই। ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশের সিন্ধিদের কাছে ইলিশ পরম পছন্দের। ওরা বলে পাল্লা। পাকিস্তানে এই পাল্লা ধরার জন্য আছে বাংলাদেশের মৎসজীবীরা। করাচীতে একটা পল্ল­ীই আছে। কিন্তু তারা যাপন করছে মানবেতর জীবন। নেই কোন নাগরিক অধিকার তাদের।
উড়িয়াদের কাছে মাছ মানে ইলিশ। চাকরি মানে পুলিশের। তাই তো একটা ছড়াই আছে: মাছ খাইবি ইলিশি, চাকরি করিবি পোলিসি। এই প্রসঙ্গে আরো একটি ছড়া কথা মনে আসে। এক সত্যেন বাবু ছড়া লিখতে পারলে আরেক সত্যেনবাবুই বা বাদ যাবে কেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়া শুরুতেই উল্লে­খ করেছি। তবে এই সত্যেন্দ্রনাথ আবার ঠাকুর পরিবারের। রবীঠাকুরের বড় দাদা। বাংলার প্রথম আইসিএস। তিনি বোম্বে থাকতেন চাকরি সূত্রে। সিন্ধিদের ইলিশ প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তিনি লেখেন: যব পাল্লা মাছলি খানা, তব সিন্ধ ছোড়কে নাহি জানা। ইলিশের আরো চমৎকার কিছু নাম আছে: জলতাপী, কাজলগৌরী, মুখপ্রিয়া।

জীমূতবাহন থেকে হ্যামিল্টন সাহেব
ইলিশের বৈজ্ঞানিক নাম প্রথম দেন হ্যামিলটন বুকানন সাহেব। ১৮২২ সালে। তখন তিনি বঙ্গোপসাগেরের মাছ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি দেন হিলসা ইলিশা। তবে ইলিশ নিয়ে কম ঘাঁটাঘাঁটি করেননি ওপার বাংলার লেখক দিগেন বর্মণ। তাঁর ছোট্ট একটি বইতে (ইলিশ পুরান) ধরা আছে আদ্যপান্ত। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন যে, দ্বাদশ শতকে ইলিশ নাম দেন পন্ডিত জীমূতবাহন। আবার সর্বানন্দের ‘টীকাসর্বস্ব’ রয়েছে ইল্লিষ-এর উল্লেখ। কবি ভারতচন্দ্র বলেছেন ‘পাঙ্গাস ইলিশা’। পাঙ্গাস শব্দটি বৃহৎ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
আবার মোট পাঁচটি মাছকে নিরামিষ আখ্যায়িত করে নিরামিভোজীদের সুবিধা করে দেন সেই সময়ের শাস্ত্রকাররা। এই তালিকায় আছে: ইলিশ, খলশে, ভেটকি, মাগুর আর রুই।

পণ্যদূত
প্রচারণাতেও নানা ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ইলিশ। ইলিশের কথা আসলে আমার সবার আগে মনে আসে ফিলিপসের বাল্বের বিজ্ঞাপনটি। একসময় বেজায় জনপ্রিয় হয়েছিল: মাছের রাজা ইলিশ। আর বাত্তির রাজা ফিলিপস।
বেশ আগে পশ্চিমবাংলায় একটি বিজ্ঞাপন ছিল: দুহাজার টাকার উপরে সোনার জিনিষ কিনলে একটি ইলিশ মাছ ফ্রি।
এখানেই শেষ নয়। বরং আরো আগের কথা। এক থিয়েটার কোম্পানির মালিক দর্শক টানতে শো শেষে একটি করে ইলিশ দেবার ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। তাতে লেখা থাকত: অভিনয় দেখিতে আসিবার সময় গৃহিনীকে বিশেষ করিয়া বলিয়া আসিবেন যেন শেষ রাত্রে উনানে আগুন দিয়া তৈল প্রস্তুত রাখেন। অভিনয় দেখিবার পর, বাড়ি গিয়া গরম গরম ইলিশ মাছ ভাজা খাইয়া মন-রসনা তৃপ্তি সাধন করিবেন।
এক সময় এটাও বলতে শোনা গেছে: মাইরের সেরা পুলিশ, মাছের সেরা ইলিশ।
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে জনপ্রিয় হয়েছিল একটি ছড়া: ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বুয়াল মাছের দাড়ি/ ইয়হিয়া খান ভিক্ষা করে/ মুজিবের বাড়ি।

ইলিশ, ইস্টবেঙ্গল আর ভাগ্যকূলের পরম্পরা
কলকাতার কুমোরটুলিতে জন্ম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের। বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলের নাগরপুরের জমিদার সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর অনুরোধে আর যারা এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন তাদেরই একজন ভাগ্যকুলের জমিদার যদুনাথ রায়। প্রথম কমিটিতেও তিনি ছিলেন। তবে তিনি একা নন তাঁর পুরো পরিবার বলতে গেলে ছিল ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। এখনও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। কেবল নামে নয়, পূর্ববাংলার গর্বের প্রতীক ইলিশ হয় ইস্টবেঙ্গলের প্রতীক। পৃথিবীর আর কোন ক্লাবের প্রতীক হিসাবে মাছ আছে কিনা আমার জানা নেই।
একটা সময় পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল ও আর চিরপ্রতিদ্বন্দী মোহনবাগানের খেলায়, ইউরোপিয় ঢঙে যেটা এখন কলকাতা ডার্বি বলা হয়, ইস্টবেঙ্গল জিতলে কলকাতায় ইলিশের দাম বেড়ে যেতো।
এবার ভাগ্যকূলের জমিদারদের ইলিশ পরম্পরার প্রসঙ্গে আসা যাক। আজও শারদীয়ায় ইলিশ-পরম্পরা রক্ষা করে চলেছেন তাঁরা। ভাগ্যকুলের রায়েরা এখনও পুজোর দিনগুলোতে ইলিশ খেয়েই কাটান বলে জানা যায়। তাদের ইলিশের নানা মেনুর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, ইলিশের ডিমের ভাপা। পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখো-মাখো ডিম-ভর্তা। জনৈক খাদ্যরসিক আবার একে কেভিয়ারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তবে ভাগ্যকূলের জমিদারই হোক আর সাধারণ মানুষ নতুন উদ্ভাবনে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। এক্ষেত্রে ভর্তার কথা আসে সবার আগে। বাঙালির আরেক উদ্ভাবন ইলিশের মাথা আর লেজ ভর্তা। এটা মাওয়া ঘাটের রন্ধনশিল্পীদের আবিষ্কার। আর তা নাকি চেটেপুটে খাওয়ার মতো সুস্বাদু।

ফেলনা নয় কিছুই
ইলিশের কিছুই ফেলনা নয়। ইদানিং ইলিশের আঁশ সুন্দর করে পরিষ্কার করে চিপসের মতো করে ভেজে খাওয়া হচ্ছে। ইলিশের যকৃত তো আগে থেকেই খাওয়ার চল রয়েছে। যেটাকে বলা হয় লুকা। আর এই লুকার পাতুরিও হয়। আবার লুকার তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খাওয়া কোন কোন অঞ্চলের ডেলিকেসি। ইলিশ মানুষকে সত্যিই বিহ্বল করে। এ যেন স্বর্গে র অপ্সরা। ঋষির ধ্যান ভাঙাতে ওস্তাদ। আর তা না হলে খোদ বুদ্ধদেব বসু ইলিশ প্রেমে মজে নিজস্ব রেসিপিও দিয়েছেন। আমরাও সেগুলো দিতেও কসুর করিনি। চেষ্টা করে দেখতে পারেন আপনিও।

ইলিশে দৈবের বশে
সিন্ধুপ্রদেশ জয় করে দিল্লি­ ফেরার পথে মারা গিয়েছিলেন খেয়ালী সম্রাট মহম্মদ বিন তুঘলক। এই মৃত্যুতে ছিল তাঁর খেয়ালীপনা। কারণ নদীপথে যাওয়ার সময় তাঁর হঠাৎ মাছ খেতে ইচ্ছে হয়েছিল। এখন সুলতানের ইচ্ছে বলে কথা। তাই তাঁকে যথেচ্ছ মাছ খাওয়ানো হলো। আর তাতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং পৃথিবীর মায়া কাটালেন। কিন্তু কি মাছ খেয়ে তাঁর পরপারের অতিথি হতে হয়েছিল তা কোন ইতিহাসবিদ লিখে যান নি। তবে আমাদের একমেবদ্বিতীয়ম সৈয়দ মুজতবা আলির ধারণা, ইলিশে দৈবের বশে তুঘলকের প্রাণবায়ু নিশ্বেষ হয়েছে।
তবে ইলিশ খেয়ে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যু হোক বা না হোক, আরেক নবাব ইলিশকে মহিমান্বিত করে রেখে গেছেন এক পদসৃষ্টির অনুঘটক হয়েছে। তিন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। তিনি ইলিশ ও খাবেন আবার পোলাও ও। কিন্তু সেটা একসঙ্গে হতে হবে। তাঁর হেঁশেলে বাবুর্চিরা সব পুর্ববাংলার। ফরমায়েশ পেয়ে তাঁরা নবাবের জন্য দস্তরখান সাজিয়ে দিলেন সেই ইলিশ পোলাওয়ে। যার নাম হলো মাহি পোলাও। এখনও টিকে আছে মুর্শিদাবাদে।

আলী ও ইলিশ
মুজতবা আলি মনে করেন, ইলিশের আকর্ষণ ঐন্দ্রজালিক। মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তাঁর কথাই ঠিক। কারণ হিতাহিত জ্ঞান যে থাকে না সে প্রমাণ তিনি নিজেই দিয়েছেন। এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সঙ্গে খাওয়া নিয়ে আলোচনায় তিনি ইলিশের পক্ষে। সরু চালের ভাত আর গঙ্গার ইলিশই শ্রেষ্ঠ খাবার। আর অধ্যাপক বেচারা বিরিয়ানির দিকে। এর পর মুজতবা আলী রাগে নাকি ঐ অধ্যাপকের সঙ্গে সাতদিন কথা বলা বন্ধ রেখেছিলেন।
মুজতবা আলী ছিলেন নিদারুণ রসনাবিলাসী। খাওয়ার স্বাদ আর সহবত জানতেন। তাই পান থেকে চুন খসলে বিলক্ষণ বিরক্ত হতেন। একবার এক দাওয়াতে টেবিল সাজানো হয়েছে একাধিক মাংসের পদের সঙ্গে ইলিশ মাছ। আর তা দেখে বেজায় চটলেন তিনি। উঠে পড়লেন টেবিল থেকে। কারণ তাঁর কথা হচ্ছে, ইলিশের সঙ্গে অন্য কিছু যায় কি ভাবে? পরে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁকে খাওয়ানো সম্ভব হয়।
ইলিশ তাঁর কাছে অমৃত। একটা আস্ত ইলিশ মাঝ বরাবর ফেড়ে মসলা মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে সেদ্ধ করলে যেটা দাঁড়াবে তা স্বর্গীয়। এই পদ যেমন স্বাস্থ্যকর তেমনই উপাদেয়। একা আড়াই-তিন কিলো মাছ খেলেও কিছু হবে না। এই পরামর্শও তাঁর।
মুজতবা আলির ইলিশ অনুরাগ বর্ণনাতীত। বেহেস্তে ইলিশ নেই বলে তিনি বেহেস্তেই যেতে চাননি।

ইলিশ ও গোপালভাঁড়
ইলিশ নিয়ে কথা হবে আর সেখানে গোপাল ভাঁড় থাকবে না তা কি হয়? একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়কে বললেন আচ্ছা গোপাল তুমি যদি নদীর পাড় থেকে এক জোড়া ইলিশ কিনে সোজা রাজ দরবারে চলে আসতে পার কারো কোন প্রশ্নে মুখে না পড়ে তাহলে তোমাকে পুরস্কৃত করবে। শুনে তো গোপাল এক কথায় রাজি। কারণ এ আর এমন কি কঠিন কাজ। অতএব রাজার চ্যালেঞ্জ নিয়ে গোপাল ঠিকই এক জোড়া ইলিশ কিনে কানকোর মধ্যে দিয়ে রশি ঢুকিয়ে হাঁটা ধরলেন রাজবাড়ির দিকে। তবে তার আগে নিজের ধুতিটা তুলে মুখ ঢেকে নিলেন। রাস্তায় তাকে দেখে আর কেউ টু শব্দটি করল না। বরং কেউ হেসে গড়াল। কেউ আবার গম্ভীর হলো। মেয়েরা যে যেখানে ছিল মুখ ফেরালো। অনেকে কনাঘুষো করল: দেখ, দেখ পাগল আবার ইলিশ কিনেছে।

ইলিশের পুষ্টিগুণ
ইলিশ দারুণ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে আছে ২১.৮ গ্রাম প্রোটিন, ২৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১৮০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৩.৩৯ গ্রাম শর্করা, ২.২ গ্রাম খনিজ ও ১৯.৪ গ্রাম চর্বি। এ ছাড়া আছে নানা ধরনের খনিজ, খনিজ লবণ, আয়োডিন ও লিপিড। ইলিশের খাদ্যশক্তির পরিমাণও অন্যান্য প্রাণিজপ্রোটিনের চেয়ে বেশি। ১০০ গ্রামে ২৭৩ কিলোক্যালরি। ইলিশে ভিটামিন এ ও ডি রয়েছে। আছে অ্যামাইনো ভ্রূণের উপযুক্ত বৃদ্ধি আর হৃদরোগ হ্রাসে ইলিশের তেল অত্যন্ত উপকারী। কারণ এতে রয়েছে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। আর এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের ইপিএ আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। তাহলে জমিয়ে ইলিশ খাওয়াই যেতে পারে।আর এই লকডাউনে নদী দূষণ থেকে রেহাই পাওয়ায় ইলিশের সাইজও অন্যবারের তুলনায় বেশ বড়সড়ই হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ প্রয়োজন, ইলিশ মঙ্গলের প্রতীক। শাস্ত্রেও রয়েছে তাঁর গুণবর্ণন: ইলিশ মাছ স্বাদে মধুর, রুচিবর্ধক, বলবর্ধক, অম্লদূর করে, পিত্ত দূর করে, বাত কমায়; আর তা পুষ্টিকরও।

ইলিশের তেল, কমলবাবুর মস্করা
ইলিশের তেলের কথা আসলে কমলকুমার মজুমদারের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। তিনি অবশ্য পদ্মার ইলিশকে পাত্তা দিতে নারাজ। তাঁর মতে পদ্মা নয় গঙ্গার ইলিশই উপাদেয়। এর কারণ হিসাবে তাঁর ব্যাখ্যা গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর কোম্পানির (বৃটিশের) তেল খেয়েছে। তাই তেলতেলে হতে বাধ্য। তাই স্বাদ হবে না কেন।
সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের সাফ কথা: কাঁচা ইলিশের ঝোল রাঁধুক তো ঘটিরা! চাপানেও কম যান না আরেক লেখিকা জ্যোস্না দত্ত: ঘটিদের উদ্ভাবন দই ইলিশ। পূর্ববঙ্গে তো দইয়ের চলই নেই।

যত পদ
লখীন্দর সম্পর্কে তারকার নন্দাই। তাঁর জন্য ইলিশের মাথা দিয়া সরিষা শাখ রান্নার কথা পাওয়া যায়। আবার এই লখীন্দরের বিয়েতে কনেপক্ষ বেহুলার বাবা পাত্রপক্ষকে অন্ততপক্ষে পনোরো পদের মাছ দিয়ে আপ্যায়ান করেন। এই তালিকায় ছিল ইলিশ। পরিবেশিত হয়েছিল ভাজা ইলিশ।
ইলিশ কত ভাবে যে রান্না করা যায় তার ইয়ত্তা নেই। তবে অন্তত পাঁচ শর মতো পদ আছে ইলিশের। তবে যে যাই বলুক স্বাদ করে ইলিশের ঝোল রাঁধতে পারলে সেই বউও কিন্তু সোনা বউ হয়ে যায়। বিশ্বাস না হলে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছড়াটা পড়ে নিতে পারেন: সোনা নাচে কোনা/ বলদ বাজা ঢোল/ সোনার বউ রেধে রেখেছে/ ইলিশ মাছের ঝোল।

ইলিশ প্রশস্তি
সেই ইলিশ, যার সম্পর্কে সংস্কৃত প্রশস্তি গেয়েছিলেন কোনও এক বাঙালি কবি: ‘বায়ু বিশ্বকে ধারণ করে আছে, তার উপরে আছে কচ্ছপ, তার উপরে শেষনাগ, তার উপরে পৃথিবী, তার উপরে কৈলাস শৃঙ্গ, তার উপরে গঙ্গা আর তার উপরে ‘ইল্লিশ’। এই ইলিশ মৎসরাজ। এর মাহাত্ম্য সর্বজনবিদিত। এই ইলিশ ভক্ষণে সকল দুঃখ থেকে মুক্তি।’ তবে ১৭১১ সালে রামেশ্বর চক্রবর্তীর ‘শিবায়ন’ ইলিশের উল্লে­খ যেন বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়া। তবে এর এক দশ বাদে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কাশীর গঙ্গায় ইলিশ পাওয়ার কথা জানা যায়।
১৮৯৭ সালের ‘কষ্টিপাথর’ নাটকে মেলে ইলিশের উল্লে­খ। এরপর ব্রহ্মদেশ থেকে পারস্য উপসাগর পানি কম গড়ায়নি। আর ইলিশ স্থান পেয়েছে কবিতা, ছড়া, গল্প, লোকগানে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের গল্প, বুদ্ধদেব গুহর গল্প সংকলন, বুদ্ধদেব বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায় মহম্মদ রফিকের কবিতা তো আছেই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীই বাদ যাবেন কেন। তিনি তো ইলিশের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছে। সুলক্ষণ ইলিশ। মানে যে ইলিশের পেটে সদ্য ডিমের ছড় পড়েছে। আর সাহিত্যিক শংকর তো আবার ইলিশকে ব্রাহ্মণ বলেছেন। ইলিশে পিঠে যে দাগ থাকে তাকে তিনি উপবীত আর পৈতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে যাই বলি প্রথমনাথ বিশীর ‘গঙ্গার ইলিশ’ গল্পটি কিন্তু সরস আর হৃদয়গ্রাহী। তবে গুলজারের গল্প ‘ইলিশ’ অন্যতর দ্যোতনাবহ। ‘ইলিশ মাছেরা এবং বাবা’ সারের এক অভিবাসী বাঙালি পরিবারের গল্প। সালেহা চৌধুরীর। ছুঁয়ে যায়। ইলিশ মাছ নিয়ে সংকলন করেছেন মঈনুল হাসান ও মোজাফফর হোসেন ‘কল্পে গল্পে ইলিশ’।
রসরাজ অমৃতলাল বসু গানও লিখেছেন। সেখানে তিনি ইলিশের তেলকে কড লিভার অয়েলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখন কিন্তু সেটা প্রমাণও হচ্ছে। খোদ রবীন্দ্রনাথই বা বাদ যাবে কেন। ছড়াও লিখেছেন আবার উপমাও করেছেন। এমনকি ইলিশপ্রীতি তাঁর সাংঘাতিক ছিল। শিলাইদহে বাড়িতে একবার এক ভোজ আসর আয়োজনের কথাও জানা যায়।
জনৈক বিদেশিনীর লেখা ‘আ ম্যারেজ টু ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বাঙালি নারীর হাতের ইলিশ খেলে তাকে ‘আনপ্যারালালড হিলশা ফিশ কারি’ আখ্যা দিতে কৃণ্ঠিত হননি।
বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পাক প্রণালী গ্রন্থে মাত্র ইলিশের চারটি পদের কথা উল্লেখ করেন। এর একটির ইলিশ ভাতে (ভাপে নয়)।
বাজার করার ব্যাপারে নিজেকে আনাড়ি মনে করতেন বুদ্ধদেব বসু। দুয়েকবার যেতে হলেও ঠিকঠাক কিছুই আসত না। ফলে তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসুই সব সামলাতেন। তবে ৬৫ বছরে এসে তিনি রান্নাবান্না নিয়ে একখানা বই লিখে ফেললেন। ‘ভোজন শিল্পী বাঙালী’ তাঁর নাম এই বইয়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে তিনি ইলিশকে উল্লেখ করেছেন মনিসত্তম হিসাবে। চিতলের প্রসঙ্গ ধরে তিনি ইলিশে আসেন। চিতল মাছের ‘মুঠিয়া’ তাঁর ভাষায়: বঙ্গসংস্কৃতির আনন্দ মেলায় পুর্ববাংলার এক বিশিষ্ট অবদান। এরেপরেই তিনি লিখেছেন: আর সেই রজতবর্ণ মনোহরদর্শন মৎস্যকুলরাজ মহান ইলিশ। তিনি মনে করতেন, সে এক দেহে এতটা প্রতিভা ধারণ করে যে, শুধু তাকে দিয়েই তৈরি হতে পারে একটি পঞ্চপদী নানা স্বাদযুক্ত ভোজনের মতো ভোজন। আর পাঁচপদ কি এবং কিভাবে রেঁধে মধ্যাহ্নভোজ সারা যাবে সেটাও বলতে কসুর। এমন কি কিভাবে কাটলে ইলিশ রান্না জমবে সেটাও তিনি উল্লে­খ করতে ভোলেননি। তবে হ্যাঁ ইলিশে ত্রিসীমানায় পেয়াজ আর আদাকে ঘেঁষতে দিতে তিনি নারাজ। শুধু কি পেয়াজ আর আদা। আলুও নৈব নৈবচ। তাঁর কথায় ইলিশে আলু যোগ করা মানেই মহাপাতকের কাজ।
আর এখানেই তো তাঁর সঙ্গে তফাৎ ঠাকুরবাড়ীর মেয়ে মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনী প্রজ্ঞাসুন্দরীর। তিনি আবার ইলিশের স্বাদ খোলতাই করতে আদা আর পেয়াজ সঙ্গতে প্রত্যয়ী। তাঁর ইলিশমাছের ঝোল রাঁধার প্রণালী বাতলেছেন তাতে রয়েছে বিলাতি বেগুন বা তেমতি (টোমাটো), সাথে ছটি পেঁয়াজ, দুখানা তেজপাতা, ছয় গ্রাম আদা এবং ধনেশাক। বুদ্ধদেব বসু দেখলে নির্ঘাৎ মুর্ছা যেতেন। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর ভাষায় ইলিশের রক্তই এর তেল। তাই মাছ ভালো করে ধুরে তবেই কাটতে হবে।
কলকাতার বাবুরা বাইজি বাড়ি ঠেঙিয়ে ভোররাতে এসে ঘুমোতেন। তাই উঠতে উঠেতে সূর্য হেলে যেত পশ্চিমে। আর তখন হতো তাদের নাস্তা কম করে পঁচিশ পদ দিয়ে। সেই তালিকায় থাকত ভাপা ইলিশ। এই গল্প বাংলার টপ্পার শেষ সলতে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
সৈয়দ আলী আহসানের বর্নণায় আছে গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটের ইলিশ। সতীনাথ ভাদুড়ির জাগরিতেও উল্লেখ। বাদ কেন দিই হালের সব্যসাচী শ্রীজাতকে। তাঁর ইলিশগীতিকা ছড়ায়: শুরুটাই তো মনমজাবে: ভোলা মন, ইলিশ নামের গুণটি গেয়ে যাই। সমে এসে বলি তের নদী সিনেমার কথা। যেখানে একটা দৃশ্য আছে ইলিশ নিয়ে। বারীণ সাহা পরিচালিত এই ছবিতে স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো ইলিশের ঝাঁক সূর্যের আলো ঝিকমিকিয়ে উঠছে। এ যেন বাঙালি জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। এভাবেই তো বাঙালি ইলিশ নিয়ে নিদারুণ আত্মশ্লাঘা বোধ করে। গৌরবান্বিত হয়। জয়তু ইলিশ। জলের উজ্জ্বল শস্য।

তথ্যঋণ: ইলিশ পুরান: দিগেন বর্মণ, ভোজন শিল্পী বাঙালী: বুদ্ধদেব বসু, মছলিশ: আলপনা ঘোষ, পাক-প্রণালী: বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়, শুভদীপ বোয়ালের প্রবন্ধ: বাঙালি চার সহস্র বছরের খ্যাদ্যাভাষ ও খাদ্যাচার: বিবর্তন ও অনুসন্ধান (সপ্তডিঙা, বিশ্বকর্মাপুজা সংখ্যা ২০১৯)
লেখক: প্রথম আলোর উপসম্পাদক

Share it in social media


আরও খবর