‘কারি লেজেন্ড’ নাজির উদ্দিন ও তাঁর সময় (১৯১২ – ১৯৮৭)

সৈয়দ নাহাস পাশা 
 

ঠিক কবে থেকে বিলেতে বাঙালিদের আগমন শুরু তার সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে বিলেতে আগমনের পর বাঙালিরা যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসাকে প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। প্রথম দিককার সেইসব বাঙালিদের সাহস, উদ্যোগ আর প্রচেষ্টার ফল আজকের এই বিশাল কারি ইন্ডাষ্ট্রি। যা ব্রিটেনে প্রতিদিন মিলিয়ন মানুষের রসনা বিলাসের পাশাপাশি অর্থনীতিতে বছরে চার বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি অবদান রাখছে। সেই সঙ্গে করে দিয়েছে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান।
আমাদের পূর্ব পুরুষদের অক্লান্ত পরিশ্রমে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যাওয়া কারি ইন্ডাষ্ট্রিকে ব্যবহার করে হালে গাজিয়ে উঠা কেউ কেউ এমন সব বক্তৃতা-বিবৃতি দেন যেন তাঁরা এই শিল্পের মহা হর্তাকর্তা! কারি শিল্পের উৎপত্তির বিষয়ে প্রকৃত কোনো গবেষণা না করেই একেক সময় একেক জনকে কারি পাইওনিয়ার হিসেবে হাজির করেন। নানা কারণে এসব লোকের কর্মকা-ে ঢাকা পড়ে যায় নাজির উদ্দিনের মত প্রকৃত কারি পাইওনিয়ারদের অসাধারণ কৃতিত্বের দুঃসাহসী গল্প।

‘কারি লেজেন্ড’ নাজির উদ্দিন বিলেতে এসেছিলেন সেই ১৯৩৪ সালে। বিগত শতাব্দীর বিশ, তিরিশ ও চল্লিশের দশকে ভারত বর্ষের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ আসামের সিলেট অঞ্চলের অনেক মানুষই জাহাজ থেকে নেমে বিলেতে বসবাস শুরু করেন। সোজা কথায় যাকে বলা হয় ‘জাম্প দ্যা শিপ’ বা জাহাজ পলাতক। সিলেট অঞ্চলের মানুষরা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বলেই হয়তো তখনকার দিনে মার্চেন্ট শিপে চাকরি নিয়ে কলকাতায় জাহাজে উঠতেন। এরাই বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসেক্সের টিলবারি, লিভারপুল, ডান্ডি ইত্যাদি বন্দরে নেমে পড়ে আর জাহাজে ফিরে যেতেন না। তাদের সূত্র ধরেই পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তুর দশকে বিলেতে বাঙালির বসতি বৃদ্ধি পায়।

নাজির উদ্দিন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিলেতে যারা কারি রেষ্টুরেন্টের গোড়াপত্তন করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নাজির উদ্দিন। ত্রিশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত তিনি রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। আজকে যাঁরা নানা ব্রান্ডের বোতলজাত নানা ধরণের কারির পেইষ্ট বিক্রি করেন বিলেতে এর প্রবর্তক ছিলেন নাজির উদ্দিন। সম্প্রতি কারি লাইফ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নাজির উদ্দিনের একমাত্র মেয়ে মিনারা কুক-এর । বাবার মুখে শোনা অনেক গল্পই বলছিলেন তিনি। বাবার কঠোর পরিশ্রম আর মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত মিনারা সযতনে বাবার স্মৃতিগুলো এখনো লালন করেন। ধরে রেখেছেন স্মৃতির কিছু নিদর্শন। ষাটের দশকে ম্যাঞ্চেষ্টার ইভনিং নিউজে দেওয়া নাজির উদ্দিনের এক সাক্ষাৎকার থেকেও জানা গেল তাঁর জীবনের অনেক কথা। ম্যাঞ্চেষ্টারে ছিল তাঁর দুটি রেষ্টুরেন্টও। প্রথমটি বোম্বে ও পরবর্তীতে মঞ্জিল। বোম্বে বন্ধ হয় ১৯৬৩ সালে আর মঞ্জিল চালু হয় ১৯৬১ সালে যা চালু ছিল আশির দশকের শেষ পর্যন্ত। মিনারা বলেন, বোম্বে রেষ্টুরেন্ট চালু থাকার সময়ে আমি অনেক ছোট ছিলাম। স্কুল থেকে রেষ্টুরেন্টে গেলে আমরা কিছু খাওয়ার পরেই কাস্টমাররা আসার পূর্বেই বাসায় চলে যেতে হতো। তবে মঞ্জিল রেষ্টুরেন্ট সম্পর্কে বলেন, ম্যাঞ্চেষ্টারে অনেক ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট হয় পরবর্তীতে। কিন্তু মঞ্জিলের স্ট্যান্ডার্ডই ছিল অন্যরকমের । আমার স্মৃতিপটে এখনো ভেসে উঠে রেষ্টুরেন্টের গেইটের সেই লম্বা দারোয়ানের কথা। গায়ে তাঁর লম্বা পাঞ্জাবি আর মাথায় পাগড়ি। আহমদ খান নাম ছিল তাঁর। রেষ্টুরেন্টের বাইরে সন্ধ্যা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই কাস্টমারের লাইন পড়ে যেত। আর সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। মিনারা বলেন, বাবা ও মা দুজনে দুজনকে খুব ভালবাসতেন বাবা নজির উদ্দিন মারা যান ১৯৮৭ সালে আর তা মা মারজোরি উদ্দিন মারা যান ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর।

নাজির উদ্দিন ও তাঁর মেয়ে মিনারা

কারি লিজেন্ড নাজির উদ্দিনের জন্ম ১৯১২ সালে সিলেটের বনগাঁওয়ে। সেখানেই তাঁর বেড়ে উঠা। পড়াশোনা করেছেন মৌলভীবাজারের একটি মাদ্রাসায়। নাজির উদ্দিনের বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে মৌলভি বানাবেন। কিন্তু দুরন্ত কিশোর নাজির উদ্দিনের স্বপ্ন ছিলো অন্য কিছু করার। মাদ্রাসা ছেড়ে দেওয়া ছেলেকে বাবা বললেন ক্ষেতের জমিতে কাজ করতে। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে ‘হট টক’ হয় তাঁর। মিনারা বলেন, সম্ভবত বাবার ইচ্ছা ছিলো বিশ্ব ভ্রমণের। সে কারণেই হয়তো তাঁর বড় বোনের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে এক বন্ধুর প্ররোচনায় কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। তাঁর ভাবনায় ছিলো কলকাতায় ইংরেজি ভাষা শিখতে পারবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন সব কিছুই মিথ্যা। জীবন আরও কঠিন। হতাশ হন তিনি। চিন্তায় পড়লেন কি করবেন। তিনি কিছু অর্জন ছাড়া বাড়ি ফিরতে চান না। সিলেট থেকে বাবা ও বোন টাকা পাঠালেন বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু আত্মসম্মান বোধে লাগে তরুণ নাজির উদ্দিনের। চাকরি নেন মার্চেন্ট নেভিতে স্টোকার হিসেবে। সেই তাঁর যাত্রা শুরু। দীর্ঘ আট বছর চাকরির সুবাদে তিনি সাগরের পর সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকার অনেক দেশে গেছেন। কাজের অবসরে ইংরেজি শেখার চর্চা চালাতেন। এক সময় সেই চাকরিতে আর মন টিকছিল না।
নানা দেশ ঘুরে ১৯৩৪ সালে জাহাজ এসে ভিড়ে লন্ডনের অদুরে টিলবারি ডকে। নাজির উদ্দিনের মনে তখন বাসা বেঁধেছে হতাশা। হাতে টাকা পয়সা নেই, সঞ্চয়ও করতে পারেননি। হতাশাগ্রস্ত নাজির উদ্দিনকে তাঁর কয়েকজন বন্ধু পরামর্শ দেন জাহাজ থেকে পালিয়ে লন্ডনে উঠে চাকরি খোঁজার। যেই বলা সেই কাজ। আর তখন থেকেই শুরু হলো তাঁর বিলেতি জীবন।
বাবার স্মৃতিচারণ করে মিনারা বলেন, বাবা সারা জীবনটাই কাটিয়েছেন কারি ব্যবসাকে ঘিরে। অনেক রেষ্টুরেন্ট করেছেন। ১৯৮৭ সালে মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ম্যাঞ্চেষ্টারের সবচেয়ে সেরা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট মঞ্জিল পরিচালনা করেছেন। তখন যুক্তরাজ্যে কে না জানতো ম্যাঞ্চেষ্টারের মঞ্জিল রেষ্টুরেন্টের কথা।

Mrs Uddin

মিসেস মারজোরি উদ্দিন

নাজির উদ্দিনের সব সময় ইচ্ছা ছিলো ব্রিটেনে আসার। তাঁর কয়েকজন বন্ধু আগে থেকেই বিলেতে ছিলেন। সেই বন্ধুদের পরামর্শে তিনি লন্ডনের টিলবারি ডকে জাহাজ থেকে নেমে কেটে পড়েন। তখন লন্ডনে কাজ পাওয়া বেশ কঠিন ছিলো। কিন্তু একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কিচেন পর্টার হিসেবে তাঁর কাজ মিলে যায়। তিন মাস কাজ করার পরে তিনি একই রেষ্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ নেন। এক পর্যায়ে একই মালিকের আরেকটি রেষ্টুরেন্ট ক্যামব্রিজে চলে যান। নাজির উদ্দিনের দর্শন ছিল সহজ। তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন এবং অন্যান্য ওয়েটারের চেয়ে দ্বিগুন আয় করতে থাকেন। তিনি তখন টাকা পয়সা জমাতে উদ্যোগী হন। অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভিশনারি লক্ষ্য নিয়ে নাজির উদ্দিন নিজেই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট চালুর উদ্যোগ নেন।
১৯৩৮ সালে তাঁর হাতে চালু হয় ম্যাঞ্চেষ্টারের প্রথম ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ‘বোম্বে’। এর পূর্বে ক্যামব্রিজে থাকাকালীন তাঁর এক বন্ধু ম্যাঞ্চেস্টারে গিয়ে একটি রেষ্টুরেন্টে কাজে সহায়তার জন্য আহবান জানান। সেখানে তিনি কয়েক সপ্তাহ থাকার পরে বন্ধুটি ব্যবসা খোলার জন্য আমন্ত্রণ জানান। নিজের জমানো মাত্র ২৫০ পাউন্ডের পুঁজি নিয়ে সেই বন্ধুকে পার্টনার করে ১৯৩৮ সালে ম্যাঞ্চেষ্টারের আপার ব্রুক ষ্ট্রিটে চালু করেন শহরের প্রথম ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ‘বোম্বে’। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি নিজেই পুরো রেস্টুরেন্টের মালিকানা নিয়ে নেন। রেস্টুরেন্টের নিচে ছোট একটি দোকান করেন, যেখানে চাল, ডাল মশলাপাতিও বিক্রি শুরু করেন। কাস্টমাররা রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে বাসায় একই রকম খাবার তৈরির জন্য মশলা নিয়ে যেত। পরবর্তীতে তিনি লিভারপুলেও একটি রেষ্টুরেন্ট চালু করেন। ১৯৫৯ সালে নজির উদ্দিন প্রায় ২৫ বছর পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দেশের বাড়িতে যান। দেশ থেকে ম্যাঞ্চেষ্টারে ফিরে আসার পরে সে বছরেই জানতে পারেন তাঁর রেষ্টুরেন্ট এর বিল্ডিংটি নতুন করে তৈরির জন্য ভেঙে ফেলা হবে। পরে ১৯৬৩ সালে বোম্বে রেষ্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে তিনি ১৯৬১ সালে মাত্র ৬ হাজার ৫ শ পাউন্ডে  লংসাইটের স্টকপোর্ট রোডে বিল্ডিং কিনে মঞ্জিল রেষ্টুরেন্ট চালু করেন। মঞ্জিল ছিল তখনকার সময়ে অত্যন্ত আধুনিক রেষ্টুরেন্ট যা বিভিন্ন নামকরা ফুড গাইডে স্থান পেয়েছে। এর সুনাম ছড়িয়ে যায় সর্বত্র।

মিনারা কুক (নাজির উদ্দিনের মেয়ে)

মিনারা জানান বাবার কাছে শুনেছেন তাঁর চালু করা বোম্বে রেস্টুরেন্টে প্রথম টেকওয়ে বিক্রির প্রচলন হয়। তখন কাস্টোমাররা নিজেরা ডিশ নিয়ে আসতেন খাবার নিয়ে যেতে। তখনকার দিনে এখনকার মতো কন্টেইনার মিলতো না। ১৯৩৮ সালে তিনি নিজ হাতে কারি পেস্ট তৈরি করতেন এবং জারভর্তি কারি পেস্ট বিক্রি শুরু করেন। সম্ভবত জার ভর্তি কারি পেস্ট বিক্রির প্রচলন নাজির উদ্দিনের হাত ধরেই। এবং পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে বিখ্যাত ‘মঞ্জিল’ রেস্টুরেন্ট চালু করার পরে ‘নাজিরস লিমিটেড’ নামের কোম্পানির মাধ্যমে ছেলে জিওফ্রিকে নিয়ে ব্যবসার আরও প্রসারিত করেন। মঞ্জিল রেষ্টুরেন্টে ষাটের দশকের জনপ্রিয় তারকাদের আড্ডা ছিলো নিত্য ঘটনা। তবে নাজির উদ্দিন কেবল অর্থের পেছনে ছোটেননি। তাঁর সামাজিক ও দাতব্য কাজের পরিধিও বেশ বড়। অনেকেই তাঁর রেস্টুরেন্ট কাজ শিখে পরবর্তীতে নিজে রেস্টুরেন্ট চালু করেছেন। এভাবেই কারি শিল্পের বিস্তারে নিরব ভূমিকা রেখে গেছেন নাজির উদ্দিন। ১৯৮৭ সালে নাজির উদ্দিন ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তাঁর দুই সন্তান মিনারা কুক এবং জিওফ্রি কুক বাবার ব্যবসা নাজিরস লিমিটেড চালিয়ে যান ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। এরপর জিওফ্রি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ছেড়ে দিলেও মিনারা কারি পেস্টের ব্যবসা অব্যাহত রাখেন। ২০১১ সালে কারি লাইফ ম্যাগাজিন কারি শিল্পের অন্যতম এই পাইওনিয়ারের অসামান্য কৃতিত্বের গল্প প্রকাশ করে। একই বছর ম্যাগাজিনটি কারি শিল্পের সূচনা ও বিকাশে চমৎকার অবদানের জন্য নাজির উদ্দিনকে মরণোত্তর বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। কারি লাইফের বিশাল জমকালো বর্ণিল বার্ষিক অ্যাওয়ার্ড ও ডিনার অনুষ্ঠানে শত শত অথিতির সামনে মেয়ে মিনারা বাবার পক্ষে এই সম্মাননা গ্রহণ করেছিলেন। তখন নাজির উদ্দিনের গল্প শুনে তুমুল করতালিতে জেগে উঠেছিলো পুরো অনুষ্ঠানস্থল।
মিনারা বলেন, তখন আমাদের রেস্টুরেন্টে মদ বিক্রির লাইসেন্স ছিল না। তাই মা রেস্টুরেন্টের বাইরে এক কোনায় বিয়ারের কলসি নিয়ে বসে থাকতেন। সেখান থেকে বিয়ার নিয়ে কাস্টমারদের টেবিলে সার্ভ করা হতো।
ম্যাঞ্চেষ্টারের অ্যাপোলো ভেন্যুতে অনুষ্ঠানের পর তৎকালীন বড় বড় তারকারা এই গ্লামারাস মঞ্জিলেই রসনাবিলাস করতেন।
শার্লি ব্যাসির মত বিখ্যাত তারাকারা মঞ্জিলে প্রবেশ করলে হুলুস্থুল পড়ে যেত। মিনারা বলেন কিন্তু বাবা এসব বিশেষ কিছু মনে করতেন না। সাধারণ কাস্টোমারের মতই সেবা দিতেন। কাস্টমার বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় মসলার একটি জার নিয়ে গেলেই বরং তিনি বেশ খুশি হতেন। তিনি বলেন, অর্থ কিংবা দামি গাড়িকেও পাত্তা দিতেন না তাঁর বাবা। তাঁর কাছে নিজের আত্মপরিচয়, ব্যক্তিত্ব আর ব্যবসায়িক সুনাম ধরে রাখাটাই ছিলো সবচেয়ে বড়।
তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিলো বিশাল এই মঞ্জিলে রেস্টুরেন্ট- গোল্ড রুম, এলিফেন্ট রুম এবং পিকক রুম। নিচ তলায় ছিলো একটি বলরুম। যেখানে তিন সদস্যের ব্যান্ড দল নিয়মিত লাইভ মিউজিক করতো। রেস্টুরেন্টের ভেতরের ডেকোরেশনের সঙ্গে মিল রেখে সোনালী আর লাল জ্যাকেট পরিহিত একজন গার্ড থাকতো মূল দরজায়। সবমিলেয়ে পরিবেশটা ছিলো দারুন জমজমাট।
১৯৭০ সালের দিকে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে মঞ্জিল রেস্টুরেন্ট। সেসময় নাজির তাঁর কারি পেস্টের ব্যবসার প্রসারেও ভাল নজর দেন। তিনি পেস্টগুলোকে ক্যানে ভর্তি করার মেশিন কেনেন। কম ঝাল, বেশি ঝালের নানা পদের কারি পেস্ট তৈরি শুরু করেন। যুক্ত করেন মাদরাস, রোগান এবং ভিন্দালুসহ কৌটাভুর্তি নতুন নতুন খাবার। মঞ্জিল রেস্টুরেন্টের পেছনেই গড়ে তোলেন বড় ফ্যাক্টরি। স্থানীয় কো-অপ, ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারিসহ কর্ণার শপ গুলোতে তাঁর তৈরি কারি পেস্টের চাহিদা বাড়তে থাকে। ১৯৭৫ সালের দিকে টেসকো এবং সেইফ ওয়েসসহ ব্রিটেনব্যাপী কারি পেস্ট সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু হলে নাজির উদ্দিনের কারি পেইস্টের ব্যবসা কমতে শুরু করে। তখন তিনি নিজে সরবরাহ বাদ দিয়ে একটি ক্ােম্পানির জন্য কারি পেইস্ট তৈরি করে দিতেন, যারা অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানিতে কারি পেস্ট রপ্তানি করতো এবং রেস্টুরেন্টগুলোতেও সরবরাহ করতো।
নাজির উদ্দিনের মৃত্যুর পরে তাঁর দুই সন্তান মিনারা ও জিওফ্রি নাজির উদ্দিনের ব্যবসার হাল ধরেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে তাঁদের মা মারজোরি উদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁরা মঞ্জিল রেস্টুরেন্টসহ কারি পেস্টের ব্যবসা বিক্রি করে দেন। অবশ্য এরপর বাবার অনুপ্রেরণা থেকে মিনারা নিজের নামেই একটি কারি পেস্টের ব্র্যান্ড তৈরি করেন। মিনারাস নামে এই কারি পেস্ট ম্যাঞ্চেষ্টারের চেইন শপগুলোতে জনপ্রিয় হয়।

মঞ্জিল রেষ্টুরেন্টের মেন্যু

নাজির উদ্দিন কেবল একজন ভিশনারী ব্যবসায়ীই ছিলেন না। ছিলেন একজন দায়িত্ববান অভিভাবকও। ১৯৩৮ সালে রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গেলে শেতাঙ্গ ইংরেজ নারী মারজোরির প্রেমে পড়ে যান নাজির উদ্দিন। কয়েক মাস পর তাঁরা বিয়ে করেন। মিনারা বলেন, তখনকার সময়ে মিক্সড রেইসের বিয়েগুলো বেশিদিন টিকতো না। কিন্তু আমার বাবা-মা একসঙ্গে সংসার করেছেন আমৃত্যু।
ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় সামাজিক বিভিন্ন কাজে নাজির উদ্দিনের ভূমিকা ছিলো অগ্রগণ্য। তিনি বাংলাদেশ থেকে আসা ইমিগ্রেন্টদের খুব সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। বাবা মনে করতেন, বাংলাদেশিরা আয়-রোজগার করতে পারলে বাংলাদেশে তাঁদের পরিবার উপকৃত হবে। আবার ব্রিটেনের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে, বলেন মিনারা। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথম সরাসরি ফ্লাইট চালুর ক্ষেত্রে নাজির উদ্দিন অন্যতম ভূমিকা রাখেন বলে জানান এই মিশ্র বাঙালি কন্যা।
ম্যাঞ্চেষ্টারে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে একটি স্থায়ী মসজিদের প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করেন নাজির উদ্দিন। প্রথমে মঞ্জিল রেষ্টুরেন্টের একটি রুমে তারা জুমার নামাজের আয়োজন করেন। পরবর্তীতে ম্যাঞ্চেষ্টারের ভিক্টোরিয়া পার্ক মসজিদের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন নাজির উদ্দিন। ছোটবেলায় এই মসজিদে বাবার সঙ্গে যাওয়ার কথা স্মরণ করেন মিনারা। এরপর এইলেন গ্রোভ মসজিদের প্রতিষ্ঠায়ও অগ্রনী ভূমিকা রাখেন কারি শিল্পের এই লেজেন্ড। নাজির উদ্দিন ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার সেন্টারে রূপান্তরিত হয়। তিনি প্রতিষ্ঠার পরে বছরে নিয়মিত মোটা অংকের একটি চাঁদা দিতেন তা পরিচালনার জন্য। প্রথমে মঞ্জিল রেস্টুরেন্টেই ছিলো এই সংগঠনের অফিস। চ্যারিটেবল কাজের জন্য ১৯৬০ এবং ১৯৬১ সালে রাণীর বাৎসরিক গার্ডেন পার্টিতে দাওয়াত পান নাজির উদ্দিন।
মিনারা বলেন, বাবা মনে করতেন দান করার বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত। এটা নিয়ে প্রচারণার কিছু নেই। তিনি গোপনে মানুষকে বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা করে যেতেন।
গত ২০ নভেম্বরের ম্যাঞ্চেষ্টার ইভিনিং নিউজের এক খবরে বলা হয়, ম্যাঞ্চেষ্টারের বিখ্যাত মঞ্জিল রেস্টুরেন্টের সেই ভবনটি গুড়িয়ে দেয়া হবে। সেখানে সাতটি ভবনে মোট ৮৯ টি আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হবে। রি-জেনারেশনের এই খবরটির বেশিরভাগ অংশজুড়ে জায়গা করে নেয় নাজির উদ্দিন এবং তাঁর বিখ্যাত মঞ্জিল রেস্টুরেন্টের সাফল্যের গল্প। যার ফলে আবারও সবার স্মৃতিপটে ফিরে আসে বাঙালি সফল ব্যবসায়ী এই কারি লেজেন্ডের অনন্য কৃতিত্বের কথা।

 

একটি মজার চিঠি!

নাজির উদ্দিন শুধু একজন বিশিষ্ট ক্যাটারার্স বা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেটার্সই ছিলেন না স্থানীয় কমিউনিটিতে তাঁর বেশ সুনাম ছিল। মূলধারায় নিজে একটি অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন এবং মিডিয়ার কাছেও ব্যবসায়ী হিসাবে তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাবা নজির উদ্দিনের লিগ্যাসি ধরে রাখার জন্য মিনারা কুক এক সময় নাজিরস লিমিটেড এর হাল ধরেন। পরবর্তীতে তিনি শুরু করেন মিনারা ফুডস যা এখনো চালু রয়েছে। নাজির উদ্দিন, তাঁর পরিবার ও ব্যবসা সম্পর্কে অনেকবারই স্থানীয় পত্রপত্রিকা ফিচার ইত্যাদি ছেপেছে। তেমনি ২০০৯ সালে ম্যাঞ্চেষ্টার ইভনিং নিউজে নাজির উদ্দিনের পরিবার সম্পর্কিত একটি ফিচার পড়ে ৮৪ বছর বয়স্ক এক ভদ্রলোক মিনারাকে একটি চিঠি লিখেন। ড. এইচ এল এইরো নামের ভদ্রলোকের চিঠিতে ফুটে উঠেছে তিরিশ অথবা চল্লিশের দশকের ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টের কথা। কাস্টমার হিসাবে তাঁরা কি রকম আচরণ করেছেন, পরবর্তীতে এর জন্য অনুতপ্ত হওয়া ইত্যাদি। সে সময়য়কার ঘটনাবলী তুলে ধরা এই চিঠির মজাদার বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা অনুবাদটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম। জানি না ড. এইচ এইরো বেঁচে আছেন কি না। থাকলে তাঁর বয়স হবে এখন ৯৫।

ড. এইচ এল এইরো
৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯

প্রিয় মিসেস কুক

ম্যাঞ্চেষ্টার ইভনিং নিউজ সম্প্রতি আপনাকে এবং আপনার পরিবার নিয়ে যে আর্টিকেল ছেপেছে তা সত্যি আমাকে বেশ কৌতুহলী করে তুলেছে। এটা অনেক দুর্দান্ত মধুর সব স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
আমার বয়স এখন ৮৪ এবং বেশ আগেই অবসর নিয়েছি। কিন্তু যখন আমি তরুণ শিক্ষার্থী ছিলাম তখন বোম্বে রেস্টুরেন্টের শুরুর দিককার জমজমাট দিনগুলো আমি দেখেছি। যে ইউনিভাসির্টিতে আমি ছয় বছর পড়াশোনা করেছি, সেই ইউনিভার্সিটির কাছেই ছিলো বোম্বে রেস্টুরেন্ট।
ওই সময়ে আমাদের খুব একটা অর্থকড়ি ছিলো না, বেশ টানাটানির মধ্যদিয়ে দিন যাপন করতে হতো। কিন্তু মাঝে মধ্যে বোম্বে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য আমরা ঠিকই অর্থ জমাতাম। এই বোম্বে রেস্টুরেন্ট থেকেই আমি এবং আমার বন্ধুরা প্রথম ইন্ডিয়ান খাবারের সঙ্গে পরিচিত হই, যা ওই সময়ে নর্থে অনন্য এক ব্যাপার ছিলো। পরবর্তীতে আর্মিতে চাকরি করার সুবাদে আরও বড় পরিসরে এই খাবারের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হয়। আমার রেজিমেন্ট ‘দ্য সামারসেট লাইট ইনফ্যানট্রি’ ছিলো সর্বশেষ ব্রিটিশ ইউনিট যারা স্বাধীনতার পর ভারত ত্যাগ করে।
ওই সময়ে বোম্বে রেস্টুরেন্টের দায়িত্বে থাকা কঠোর পরিশ্রমী ভদ্রলোকের কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আমার ধারণা ওই ভদ্রলোক-ই আপনার বাবা। আমার ফাইনাল রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার রাতটি আমি এবং আমার সঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা আরও কয়েকজন মিলে বোম্বে রেস্টুরেন্টের প্রথম তলার একটি রুমে ভোজোত্সব করে উদযাপন করি। অভ্যাসের চেয়ে বেশি পরিমাণে মদ্যপান করার কারণে সেদিন আমরা বরং কিছুটা বিভোর ছিলাম। এক চ্যালেঞ্জের জবাবে আমাদের একজন মেইন রোড ঘেঁষা জানালা বেয়ে উঠে সরু ফাঁক দিয়ে বাইরে যেতে উদ্যত হয়, যা ছিলো অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমরা বাকিরা তাকে অনুসরণ করছিলাম। কিন্তু রাস্তার লোকজন ততক্ষণে জড়ো হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে এবং ভর্ৎসনা করার পাশাপাশি আমাদের দিকে নানা কিছু ছুড়ে মারতে শুরু করে।
তখন আমরা জানালা দিয়ে ভেতরে ফিরে আসার চেষ্টা করলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যর্থ হই। কারণ জানালার ওই সরু ফাঁক দিয়ে ভেতরে আসা যাচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত আমাদের নামিয়ে আনতে ফায়ার ব্রিগেড ডাকতে হয়েছিলো, সেখানে হট্টগোল সৃষ্টির দায়ে আমাদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশও অপেক্ষা করছিলো। আমাদের নিয়ে যাওয়ার আগে রেস্টুরেন্টে বড় অংকের বিল পরিশোধ করতে হয় এবং রেস্টুরেন্টে ‘বস’ জানিয়ে দেন আমরা সবাই বাকি জীবনের জন্য এই রেস্টুরেন্টে নিষিদ্ধ।
কয়েক বছর পর, আমাদের গ্রুপের একজনের বিয়ের আগে এক সন্ধ্যায় আমরা রেস্টুরেন্টের সামনে হাজির হই। মালিক সদয় হয়ে আমাদের ওপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। আমরা বেশ সভ্য হয়ে খাবার উপভোগ করি এবং আমাদের বন্ধুকে বিদায় জানাই।
তো, এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই আর্টিকেল আমার জীবনের কত মধুর স্মৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
সকল শুভ কমনায়

হ্যানস এল এইরো

Share it in social media


আরও খবর