কারি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই… (২য় পর্ব)

সৈয়দ নাহাস পাশা 
 

দুই শ’ বছর আগে বিহারের পাটনা থেকে আসা শেখ দীন মোহাম্মদ বিলেতে প্রথম ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট করেন। ১৮১০ সালে লন্ডনের পোর্টসম্যান স্কোয়ারে স্থাপিত হিন্দুস্তান কফি হাউস নামের এই রেষ্টুরেন্ট বেশি দিন টিকেনি। বাঙালি মুসলমানের ঘরে জন্ম শেখ দীন মোহাম্মদের, ১৭৫৯ সালে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার প্রদেশ ছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা। বাংলার নবাবের পরিবারের আত্মীয় ছিলেন তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষরা মোগল প্রশাসনে কাজ করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে দীন মোহাম্মদ ছিলেন পশ্চিমা দেশে আসা উপমহাদেশীয় প্রথম পরিব্রাজক ও ইমিগ্র্যান্টদের একজন। তাঁর বণার্ঢ্য জীবন, যুক্তরাজ্যে আসার পর জীবনসংগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে পরবতীর্তে কোনো এক সময় লিখব। দীন মোহাম্মদ মারা যান ১৮৫১ সালে। দীন মোহাম্মদ প্রথম ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট খুলে ব্যবসা নিয়ে় স্ট্রাগল করেছেন। ব্রিটেনে উপমহাদেশীয় খাবার পরিচিত করান এই বাঙালি। সেক্ষেত্রে তাঁকে বিলেতে ইন্ডিয়ান খাবারের জনকই বলা চলে। লন্ডনের জর্জ ষ্ট্রিটে অবস্থিত হিন্দুস্থান কফি হাউসে দেশীয় খাবারের সঙ্গে ধুমপানের জন্য হুক্কা-ছিলিমও ছিল। পোর্টসম্যান স্কোয়ারে রেষ্টুরেন্টের স্থানে একটি প্ল্যাক স্থাপিত রয়ে়ছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে পুরানো ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট হচ্ছে লন্ডনের রিজেন্ট ষ্ট্রিটে অবস্থিত ভিরাসামী। ১৯২৬ সালে এডওয়ার্ড পালমার নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসার এই রেষ্টুরেন্ট খোলেন। বিখ্যাত এই রেষ্টুরেন্ট এখনো চালু আছে। সে সময় ভিরাসামীই একমাত্র ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট ছিল না, তবে অভিজাত রেষ্টুরেন্ট হিসাবে এটি ছিল শীর্ষে। এই রেষ্টুরেন্টে অনেক বাঙালিও কাজ করেছেন বলে জানা যায়। বর্তমানে লন্ডনে একটি বিখ্যাত মিশেলিন স্টার রেষ্টুরেন্ট হিসাবে এটি মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে় রয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে নতুন মালিকানায় রেষ্টুরেন্টটি পরিচালিত হচ্ছে। চাটনি ম্যারি গ্রুপের কয়ে়কটি রেষ্টুরেন্টের মধ্যে ভিরাসামী হচ্ছে একটি।
প্রথম ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট হিসাবে যে শুভযাত্রা ও সংগ্রাম শেখ দীন মোহাম্মদ শুরু করেছিলেন তার অগ্রযাত্রা এবং প্রসার ঘটিয়ে়ছেন এই বাঙালিরাই ব্রিটেনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ার কাজে সে সময় উপমহাদেশ থেকে ইমিগ্র্যান্ট নিয়ে আসে ব্রিটেন। আর এই ইমিগ্র্যান্টরা কিন্তু মূলত ভারত বর্ষের তিনটি অঞ্চল থেকেই আসেন। ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও কাশ্মির আর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে। সিলেট অঞ্চলের মানুষ অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। সেই ব্রিটিশ আমলে মার্চেন্ট শিপে কাজ করতেন অনেক সিলেটি। ব্রিটিশ নেভিতে কাজ করেও যুদ্ধের সময় অনেকে জীবন দিয়েছেন। কলকাতা বন্দর থেকে তাঁদের যাত্রা শুরু হতো। আমার পূর্বপুরুষরা সে সময় জাহাজে কাজ করেছেন বলে গল্প শুনেছি। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই মাচের্ন্ট শিপে অনেক সিলেটি বিলেতের বিভিন্ন শহরে জাহাজ থেকে নেমে বসত শুরু করেন। লিভারপুল, লন্ডন ও স্কটল্যান্ডের ডান্ডি ছিল এজন্য বিখ্যাত বন্দর নগরী। এদের সূত্রই ধরেই কিন্তু পরবতীর্তে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট থেকে ইমিগ্র্যান্ট আসা শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে এবং ষাটের দশকের প্রথম দিকে কাজের সন্ধানে একটি প্রজন্ম এখানে আসেন। আমার বাবাও ব্রিটেনে আসেন ১৯৬১ সালে। এই প্রজন্মই মূলত কারি ইন্ডাষ্ট্রির ভিত্তি গড়েন নতুনভাবে। পরবতীর্তে তাঁদের সন্তান ও আত্মীয়স্বজন এই ব্যবসার প্রসার ঘটান। বিলেতের বাঙালিরা তাঁদের জীবনযাত্রার উন্নয়নে এবং নিজেদের চাকরি সৃষ্টি করার জন্য রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ষাটের দশকে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি, টেক্সটাইল, ইন্ডাষ্ট্রিতে কাজ করলেও তাঁদের লক্ষ্য ছিল ব্যবসা করার। সেজন্যে বাঙালিরা এন্টারপ্রোনর হিসাবে গর্ব করতে পারেন। রেষ্টুরেন্ট ইন্ডাষ্ট্রিকে কেন্দ্র করে পরবতীর্তে এন্ট্রেপ্রোনারশীপ কতটুকু ধরে রাখা গেছে সে বিতর্কে পরে যাবো। কমনওয়ে়লথ এর দেশ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল থেকে আসা বাঙালিরা জড়ান রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায় আর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা ইমিগ্র্যান্টরা ঝুঁকে পড়ে ট্যাক্সি চালানোর কাজে। দুঃখজনক হলো বর্তমানে এই স্রোত উল্টো দিকে বইছে। তখনকার বাঙালিরা রেষ্টুরেন্টে কাজ করে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে তোলেন আজকের বিশাল ৪ বিলিয়ন পাউন্ডের কারি ইন্ডাষ্ট্রী। ব্যবসায়ী হিসাবে আমাদের আত্মসম্মানবোধ অন্যান্য কমিউনিটির চেয়ে অনেক ওপরে। অনেক গর্বের। এই কারি ইন্ডাষ্ট্রিই আমাদের অর্থ প্রতিপত্তি দিয়েছে। ব্যবসা করে আমরা যা চেয়েছি, তা পেয়েছি। ছেলেমেয়েদের ভাল স্কুলে পড়ানো, উচ্চশিক্ষিত করা, উচ্চ পেশাদার করা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ী করা- সবই অর্জন করেছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা। এ নিয়ে আফসোস করার কোনো কারণ দেখি না। নতুন প্রজন্ম রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায় না এলেও সবাই তো ছেলেমেয়েদের এরকম উন্নত ভবিষ্যতই চেয়েছি।
আগেই উল্লে­খ করেছি রেষ্টুরেন্টে কাজ আমাদের অনেকের জীবনে একটি উন্নয়নের সিঁড়ি। বিশেষ করে যারা স্টার্টআপ করছেন অথবা অন্য কোনো কাজ পেতে ষ্ট্রাগল করছেন তাঁদের জন্য। এই কাজ করেই পরবতীর্তে ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন প্রায় শতভাগ রেষ্টুরেটার্স। আমাদের কারি ইন্ডাষ্ট্রীতে বিশাল স্টাফ সংকট চলছে। এর অন্যতম একটি কারণ অনেকেই বর্তমানে ট্যাক্সি চালান। অথবা রেষ্টুরেন্টে কাজ করা এখন আর তাঁদের প্রথম পছন্দ নয়। তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাবেন, কাজের স্বাধীনতা আছে বলেই ট্যাক্সি চালান। চাকরি হিসাবে সেটাকে খাটো করে দেখছি না। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ মেয়াদে সে চাকরিতে শারীরিক অসুস্থতার ঝুঁকি বেশি। একজন মানুষ ব্যবসায়ী হবেন, না চাকরিজীবী হবেন সেটা সবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায় পাকিস্তানিরা ট্যাক্সি ছেড়ে ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে আর বাঙালিরা রেষ্টুরেন্ট ছেড়ে ট্যাক্সি চালানোতে যোগ দিচ্ছে। আর সংখ্যায় দিনের পর দিন পাকিস্তানী মালিকানাধীন রেষ্টুরেন্ট বাড়ছে আর বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেষ্টুরেন্টের হাত বদল হচ্ছে। একদা হয়তো আমাদের এই উপলব্ধি আসবে তখন দেরি হয়ে যাবে। ইন্ডাষ্ট্রি থাকবে কিন্তু এর অগ্রভাগে আর বাঙালিরা থাকবে না।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের বাঙালিদের বসতি স্থাপন বা ইমিগ্র্যান্ট হিসাবে আসার সময়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০। এই সময়ে যারা বিভিন্নভাবে যুক্তরাজ্যে বসত স্থাপন করেছেন তাদেরকে প্রথম প্রজন্ম এবং পথ প্রদর্শকই বলা চলে। তাদের সময়েই কিন্তু বাঙালির রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার গোড়া পত্তন ঘটে। ১৯৩৬ সালে মানচেষ্টারে প্রথম ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট খোলেন সিলেটের মৌলভী বাজার থেকে আসা নজির উদ্দিন। ২৪ বছরের যুবক নজির উদ্দিন ১৯৩০ এর দশকের প্রথম দিকে একটি জাহাজ থেকে লন্ডনের টিলবারি ডকে নেমে যান। সেই থেকে তাঁর বিলেতে বসবাস শুরু। লন্ডনে কিছুদিন একটি রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন তিনি এবং পরবতীর্তে মানচেষ্টারে চলে যান। ২৫০ পাউন্ড পুঁজি নিয়ে তাঁর এক বন্ধুকে পার্টনার করে তিনি মানচেষ্টারের আপার ব্রুক ষ্ট্রীটে বোম্বে রেষ্টুরেন্ট খোলেন। নজির উদ্দিনই হলেন প্রথম ব্যক্তি যে বিলেতে গ্ল­াসের জারে প্রক্রিয়াজাত কারি পেইষ্ট প্রবর্তন করেন ১৯৩৮ সালে। সে হিসাবে তাঁকে প্রসেসড অর্থাৎ প্রক্রিয়াজাত কারির জনক বলা চলে। পরবর্তীতে তাকে নিয়ে আলাদাভাবে লেখার ইচ্ছে রয়েছে।
১৯৪২ সালে সাউথ ওয়েস্ট লন্ডনে ব্রম্পটন রোডে অ্যাংলো এশিয়া নামে একটি রেষ্টুরেন্ট করেন মশরফ আলী, ইসরাইল মিয়া ও তাঁর ভাই জরিফ মিয়া। তাঁরা সবাই মার্চেন্ট শিপে কাজ করতেন এবং জাহাজ থেকে নেমে যুক্তরাজ্যে বসবাস শুরু করেন। এই তিনজন পরবতীর্তে ১৯৪৪ সালে লন্ডনের চার্লস ষ্ট্রিটে কলকাতা রেষ্টুরেন্ট, ১৯৪৬ সালে হুইটফিল্ড ষ্ট্রিটে তাজমহল নামে আরও দুটি রেষ্টুরেন্ট খুলেন। তাদের পোর্টফোলিওতে পরের বছরগুলোতে আরও অনেকগুলো রেষ্টুরেন্ট যোগ হয়।
১৯৫০ থেকে ১৯৬০ এর দশকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট অঞ্চল থেকে অনেক মানুষ বিলেতে আসেন। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতির হাওয়াও এসে লাগে লন্ডনের বাঙালি মহলে। প্রয়াত প্রবাসী নেতা তাসাদ্দুক আহমদও তখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে আসেন লন্ডনে। সাংবাদিক ও বাম রাজনীতি করতেন বলে পাকিস্তান সরকারের গ্রেপ্তারের নির্দেশ ছিল। লন্ডনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্যাঞ্জেস (গঙ্গা) রেষ্টুরেন্ট বিলেতে বাঙালির রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সেসময়। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী শামসুদ্দিন খানের মহারানী রেষ্টুরেন্ট চালু হয় ১৯৫৮ সালে। এটি এখনও চালু রয়েছে। লন্ডনের ক্ল্যাপহাম এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই রেষ্টুরেন্টেরও অনেক রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই রেষ্টুরেন্টের উপরে কিছুদিন অবস্থান করেছেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এর দশকটি ছিল বাঙালিদের রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দশক। এই দশকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশি সংখ্যক ইমিগ্র্যান্ট কাজের সন্ধানে বিলেতে আসেন। যেহেতু পূর্ব থেকেই সিলেটিরা এদেশে একটি অবস্থান গড়ে তুলেছেন, এর সূত্র ধরেই সিলেট থেকে প্রচুর মানুষ লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরা ব্রিটেনে শুধু মিল ফ্যাক্টরিতেই কাজ করেননি তাঁরা রেষ্টুরেন্টেও কাজ করেন। রেষ্টুরেন্টের সংখ্যাও দিন দিন বাড়তে থাকে। জনপ্রিয় হতে থাকে ইন্ডিয়ান খাবার। লন্ডন ছাড়াও দেশের অন্যান্য সিটিতে রেষ্টুরেন্ট খোলা হতে থাকে। অনেকেই মিল কলকারখানার চাকরি ত্যাগ করে নিজে ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে রেষ্টুরেন্টে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে রেষ্টুরেন্টের মানুষের ওয়ে়লফেয়ার এবং সবাইকে সংগঠিত করার জন্য ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেন পাকিস্তান ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়ে়শন যা পরবতীর্তে বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন হিসাবে রূপান্তরিত হয়। এই দশকের অনেক ব্যবসায়ীই এখন অবসর নিয়েছেন অথবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের কাছে ইন্ডাষ্ট্রির সবাই কতজ্ঞ । তাঁদের উত্তরসুরী অনেকেই একই ব্যবসা এখনো ধরে আছেন। কোনো কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে । আমাদের এই সাফল্যকে সেলিব্রেট করার প্রয়োজন রয়েছে।
১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এর দশক। বিলেতে বাঙালির কারি ব্যবসার জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট এই দশক। মুলত এই দশক এবং এর পরবর্তী দশকে বিলেতে আসা বাংলাদেশিরাই কারি ইন্ডাষ্ট্রিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারি ইন্ডাষ্ট্রির সবকিছুতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই দুই দশকে বিলেতে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা আরেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন আমাদের রেষ্টুরেন্টগুলোকে। তাঁদের চিন্তা চেতনা ষাটের দশকের প্রবাসীদের চেয়ে ভিন্ন। ১৯৬৯, ১৯৭০ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি ছিল উত্তাল। গণ অভ্যুত্থান, সাধারণ নির্বাচনের তোড়জোর দেশে কী হচ্ছে, কী হবে এমন এক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে জনমনে। এরপরেই আসে ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসেও বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে় পড়েন। আর এই সময়েই বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে পরিবার পরিজনদের বিলেতে নিয়ে আসার একটি হিড়িক পরে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যারা একা বিলেতে আসেন তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের আনার জন্য আবেদনের লাইন পড়ে যায় ব্রিটিশ অ্যাম্বেসিতে। ১৮ বছরের কমবয়সি ছেলেমেয়েরাই শুধুমাত্র ডিপেন্ডেন্ট হিসাবে স্ত্রীর সঙ্গে ভিসা পেতেন। যাদের বয়স ১৬-এর নিচে ছিল তারা এসে স্কুলে গেছে আর যাদের বয়স এর উপরে ছিল তাঁরা কাজে গেছেন। রেষ্টুরেন্টে ছাড়া অন্য কিছুতে কাজ করার খুব একটা সুযোগও ছিল না। যাদের বয়স ১৬ এর নিচে ছিল তারাও হয় পার্ট টাইম কাজ করেছেন অথবা ১৬ হওয়ার অপেক্ষায় থেকেছেন। যাহোক এ ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা। আমি পূর্বের লেখায় উল্লে­খ করেছি সত্তুর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমিও বিলেত এসেছি। আমারও প্রথম চাকরি রেষ্টুরেন্টে, প্রথম ব্যবসা ছিল রেষ্টুরেন্ট।
১৯৭৯ সালে মাগার্রেট থ্যাচারের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় আসার পরে ইমিগ্রেশনে বেশি করে কড়াকড়ি শুরু হয়। অবশ্য এরও আগে ১৯৭৩ সালে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের মুহুর্তে নতুন ইমিগ্রেশন পলিসি গ্রহণ করে। ১৯৮১ সালে ব্রিটিশ সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, পরবতীর্তে ১৯৮৬ সালে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ এর জন্য নতুন ভিসা নীতি চালু ইত্যাদির কারণে ব্রিটেন আসার পথ কঠিন হতে থাকে। আশির দশকের শেষ দিকে এবং নব্বইয়ে়র দশকে যারা এসেছেন অধিকাংশই স্পাউস ভিসায় অর্থাৎ বিয়ে়সূত্রে এসেছেন। ছেলে অথবা মেয়ে বাংলাদেশে    বিয়ে করে স্বামী অথবা স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। যাই হোক যতই ইমিগ্রেশন আইনে কড়াকড়ি হয়েছে, তা বিয়ে সূত্রে আসা হোক, অথবা বেড়াতে এসে অ্যাসাইলামের আবেদন হোক কিংবা ডিপেন্ডেন্ট হিসাবে আসা হোক, সবকিছুই বিলেতের কারি ইন্ডাষ্ট্রির ওপর প্রভাব ফেলেছে। ওয়ার্ক ফোর্স এর একটি সংকট দেখা দিয়েছে। যে যা-ই করেছেন প্রথম কিছু দিন রেষ্টুরেন্টে কাজ করেছেন, তা অতিরিক্ত আয়ের জন্য পার্ট টাইমই হোক আর ফুল টাইমই হোক। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে এসে চাকরি করার সব পথই প্রায় রুদ্ধ, তাই এই সংকট সর্বকালের মধ্যে প্রকট। এ নিয়ে পরে আরও কোনো লেখায় আলোকপাত করা যাবে।
আমার প্রথম ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট দর্শন!
বিলেতে আসার কিছুদিন পরে ১৯৭৬ সালের কোনো এক শীতের সকালে লিডস থেকে সান্ডারল্যান্ড বেড়াতে গেলাম। ওয়ে়স্ট ইয়র্কশায়ারের লিডস সিটিকে অনেকটাই হোম সিটি বলা চলে আমার। কারণ বাংলাদেশ থেকে এসে প্রথম এই শহরে উঠেছি। সেখানেই বাবা বাড়ি কিনেছেন। বিলেতে বাঙালি যারা বাস করেন তাঁদের মধ্যেও সিলেটের নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকজন কোনো কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করেন। সত্তুর-আশির দশকে সেটা ছিল খুবই নজরকাড়া। যেমন জগন্নাথপুর থানার প্রবাসীরা এক শহরে, নবীগঞ্জের লোকজন এক এলাকায়, বিয়ানীবাজার অথবা মৌলভীবাজারের মানুষ নির্দিষ্ট কোনো শহরে। তেমনি আমার দেশের গ্রামের লোকজন বেশি থাকতেন তখন লিডস এবং সান্ডারল্যান্ড শহরে। বিশেষ করে এখনও সান্ডারল্যান্ড শহরকে অনেকেই সৈয়দপুর হিসাবে চিহ্নিত করেন।
আমার একমাত্র আপন চাচা সৈয়দ আব্দুল হক কাজ করতেন দিল্লী দরবার নামে সান্ডারল্যান্ডের একটি রেষ্টুরেন্টে। তাঁকে দেখতে বেড়াতে গেলাম আমি ও ছোট ভাই সৈয়দ বেলাল আহমদ। আমাদের সম্পর্কের আরেক চাচাও আমাদের তখন দেখতে আসেন সেই রেষ্টুরেন্টে। তিনি পাশের শহরেই বাস করতেন। সৈয়দ মজমিল আলী নামের সেই চাচাকে আমি পূর্বে কখনো দেখিনি। শুধু গল্প শুনেছি, তার কারণ তিনি আমার জন্মের পূর্বে পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে বিলেত এসেছেন। তিনি এরপরে আর কখনো দেশে ফিরে যাননি। এ এক অন্য ধরণের অভিজ্ঞতা। দিল্লী দরবার রেষ্টুরেন্টের মালিক ছিলেন কমল আলী মিয়া। বয়স্ক মানুষ। তিনি পুরনো লন্ডনি (ঐসময়ে় যারা বিলেত আসেন তাদের সিলেটে ডাকা হতো লন্ডনি) । কমল মিয়া ষাটের দশকে প্রথম দিকে তিনি সান্ডারল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন। সান্ডারল্যান্ডের প্রথম ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট দিল্লী দরবার খোলেন তিনি । কমিউনিটির লোকজন এটাকে কমল মিয়ার ক্যাফে বলতেন। এরপর তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আব্দুল মতিন নামের আরেক যুবক। এই দুইজনই সান্ডারল্যান্ড শহরে ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টের প্রসার ঘটান। ১৯৭২ সালে খুলেন মেল্টিং পট ও ১৯৭৪ সালে আব্দুল মতিন প্রতিষ্ঠা করেন মতিরাজ। এই রেষ্টুরেন্টটি এখনো চালু আছে। এ ব্যাপারে পরবর্তী পর্বে লেখার ইচ্ছে রয়েছে। কমল মিয়া ও আব্দুল মতিন দুজনই দেখা হওয়ার পরে আমাদের হাতে ৫ পাউন্ড নগদ গিফট দেন। সে আমলে নতুন কেউ এলে এ ধরণের নগদ উপহার দেওয়ার একটি রেওয়াজ ছিল। বিলেতে আসার পরে প্রথম কোনো ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে যাওয়া হলো কমল মিয়ার ক্যাফে অর্থাৎ দিল্লী দরবার। চাচার কাছে বেড়াতে গিয়ে সেখানে কয়েকদিন থাকলাম এবং অন্যান্য রেষ্টুরেন্টও দেখার সুযোগ হলো। সে আমলে ইন্ডিয়ান খাবারের রেষ্টুরেন্ট বুঝাতে নামগুলোও এভাবেই রাখা হতো যেমন, তাজমহল, দিল্লী, বোম্বে , কোহিনুর ইত্যাদি। আর রেষ্টুরেন্টের অভ্যন্তরীন সাজসজ্জাও ছিল সে রকম। দেয়ালের ডিজাইনে থাকতো সেই ইন্ডিয়ান আদলের আর্চ ও ভেলভেটের ফ্লক ওয়ালপেপার ইত্যাদি। আর রেষ্টুরেন্টে যে খাবার সার্ভ করা হতো তা ছিল শুধুমাত্র কাস্টমারের জন্য। কিচেনে কুকারের উপর বিশাল একটি হাড়ি। শেফদের কাজ ছিল সকালে ঘুম থেকে উঠে এই হাড়িতে কাটা পেয়াজ, তেল, পোটলা বেঁধে মশলা, পানি ইত্যাদি দিয়ে বয়েল করা। তারপর এটাকে হাতের ব্লেন্ডার দিয়ে সস তৈরি করা। অন্য একটি বিশাল হাড়িতে গরম মশলা ইত্যাদি দিয়ে বড় বড় ব্রয়লার চিকেন ইত্যাদি বয়েল করে নরম করা হতো। এসব চিকেন ঠা-া হওয়ার পর স্লাইসি করে পরিমাণ মতো মশলা দিয়ে হয় খুব ঝাল কারি ভিন্দালু অথবা মিষ্টি কারি কোরমা পাকানো হতো। এসব চিকেন খেতে মজাই ছিল আলাদা। কাস্টমাররা মরিচের গুড়ো দিয়ে তৈরি ভিন্দালু বা পাল নামের এমন ঝাল কারি খেতেন সেটা ছিল বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। পরবতীর্তে নিজেও রেষ্টুরেন্ট করি। এসব অপুর্ব অভিজ্ঞতার কথা আগামী সংখ্যা গুলোতে লিখবো। শুধু এটাই বলতে পারি এখনকার সময় আর আগের মতো নেই।

Share it in social media


আরও খবর