বিলেতে বাঙালিদের কঠোর পরিশ্রম ও ভালবাসা দিয়ে গড়ে ওঠা কারি ব্যবসা নিয়ে যখন নেতিবাচক প্রচারণা দেখি তখন খুবই মমার্হত হই। সাম্প্রতিক সময়ে এই ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আত্মপ্রচারে লিপ্ত, যারা নিজেদের এই ইন্ডাষ্ট্রির হর্তা কর্তা বলে মনে করেন, অনেক নেতিবাচক প্রচারণার মাধ্যমে তারা ইন্ডাষ্ট্রিকে আরও সংকটাপন্ন করছেন। প্রায়শঃই তাঁদের মুখে শোনা যায়, প্রতি সপ্তাহে অনেক রেষ্টুরেন্ট বন্ধ হচ্ছে, এই ব্যবসার কোনো ভবিষ্যত নেই, প্রেজেন্টেশনে ও খাবার মানে ‘ভারতীয়’রা সুপিরিয়র। এই কোম্পানি সেই কোম্পানি আমাদের ব্যবসার সব কিছু নিয়ে যাচ্ছে। হতাশা আর হতাশা! একের পর এক সমস্যা। অশনি সংকেত সর্বত্র। স্টাফ সংকটের কথা নাই বললাম। সফলতার কথা বলে সাধারণ রেষ্টুরেটার্সদের ইনস্পায়ার্ড বা অনুপ্রেরণা দেওয়ার কথা শোনা যায় খুবই কম। অতীতে রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ী একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে অথবা ফোনে আলাপ হলে প্রথমেই কুশলাদি বিনিময় এবং ব্যবসার খবরাখবর নিতেন। আর এখন? কথোপকথন শুরুই হয় সমস্যার গল্প দিয়ে। যাঁরা কারি ইন্ডাষ্ট্রিকে অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, পরিশ্রমের ঘাম ঝরিয়ে সফল হয়েছেন, তাঁরাও ভাল করেই জানেন ও বোঝেন, জীবনে যা কিছু অর্জন এর সবকিছুই এই ইন্ডাষ্ট্রিকে কেন্দ্র করে। তাহলে কেন এই নেতিবাচক প্রচারণা? কেন ইন্ডাষ্ট্রির সাধারণ মানুষদের তাঁরা হতাশার সাগরে ডুবাচ্ছেন। এসব ব্যবসায়ীদের আশার বাণী শোনান, পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর আহবান জানান। দেখান আলোর পথ।
বিলেতে জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম, যারা লেখাপড়া শেষ করে কারি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন তাঁদের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁরা ব্যতিক্রমি ভুমিকা রাখছেন। তাদের অ্যাপ্রোচ ভিন্ন। বৈচিত্র্য রয়েছে এর মধ্যে। ব্লেইম গেইম বা ইন্ডাষ্ট্রী রাজনীতির মারপ্যাঁচে নেই তারা। অন্ততপক্ষে নেতা হওয়ার জন্য আত্মপ্রচার থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে ব্যবসার দিকে ফোকাস থাকায় তাঁরা ভাল করছেন। আশ্বস্ত বোধ করি তাঁদের সঙ্গে কথা বললে। তাঁরাই এই কারি ইন্ডাষ্ট্রীকে এগিয়ে নেবেন। আমি হলফ করে বলতে পারি যুক্তরাজ্যে কারি ব্যবসা থাকবে, ব্যবসায়ীরা থাকবেন, সময়ের বিবর্তনে ব্যবসার হাত বদলাবে এবং ব্যবসায়ীরাও পরিবর্তন হবেন। নতুন মানুষ যোগ হবে ইন্ডাষ্ট্রীতে। এটা খুবই স্বাভাবিক। এটাও ধ্রুব সত্য যে, করোনা মহামারির কারণে অন্য সব বাণিজ্যের মতো কারি ইন্ডাষ্ট্রীও সাফার করবে। এসঙ্গে এই চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিতে পারি, ব্যাবসাও ঘুরে দাঁড়াবে, আরও শক্তিশালি হয়ে; নতুন মাত্রা যোগ হবে। এর একটাই কারণ বাংলাদেশী যোদ্ধারা লড়াই করে বাঁচতে জানে। পেটে পাথর বেঁধে সারভাইভালের জন্য যুদ্ধ করে যাবে। ব্যবসা বাঁচানোর জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নেবে। রিসেশন অতীতেও হয়েছে। ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, নতুন করে খুলেছে। সুতরাং একটাই অনুরোধ আসুন সবাই মিলে নিগেটিভ বর্জন করে পজিটিভ কথা বলি। মানুষকে ইনস্পায়ার করি।
আমার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে কোনো না কোনোভাবে কারি ব্যবসার সঙ্গে। যেভাবে মিডিয়ার সঙ্গে পার করলাম তিরিশ বছর। লেখালেখির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাড়ে চার যুগেরও বেশি সময়, সেই তরুণ বয়স থেকে। বিলেতে বাংলা মিডিয়ায় কাজ শুরুর প্রথম দিকে এরকম একটি কথা সবসময় শুনতাম, এদেশে বাংলা সংবাদপত্রের ভবিষ্যত অন্ধকার। কিছুদিনের মধেই কোনো সংবাদপত্র আর বেঁচে থাকবে না। শত বছরের বাংলা মিডিয়ার ইতিহাস ব্রিটেনে। ৪০ বছর আগেও যে কটি বাংলা সংবাদপত্র বাজারে ছিল, যুক্তরাজ্যে বর্তমানে এর চেয়ে দ্বিগুন সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এই ৬/৭ বছর আগেও লন্ডন, মানচেষ্টার বার্মিংহ্যাম ইত্যাদি শহর থেকে কুড়িটার মতো সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। এখন অন্ততপক্ষে হাফ ডজনতো রয়েছেই। রয়েছে হাফ ডজন টেলিভিশন চ্যানেলও। সব ব্যবসাতেই চড়াই উৎরাই থাকে। আজ থেকে ৭০ বছর আগে যত রেষ্টুরেন্ট এবং টেক-অ্যাওয়ে ছিল, তুলনামুলকভাবে এখন এর সংখ্যা কত? কেউ বলেন, ১২ হাজার কেউ বলেন ১০ হাজার। কোনটা ঠিক? এর কাছাকাছি কোনো এক সংখ্যা আছে সেটা তো ঠিক?
আমার এই কলামের নাম ‘কারি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই….’। আমার জীবনের প্রথম চাকরি রেষ্টুরেন্টে, নিজে রেষ্টুরেন্ট ও টেক-অ্যাওয়ে ব্যবসা করা, রেষ্টুরেন্ট জীবনে ইন্ডাষ্ট্রীর মানুষের সঙ্গে কমরেডশিপ গড়ে তোলা, এই ব্যবসার নিত্যদিনকার অভিজ্ঞতা, গত ৫০ বছরে এই ব্যবসার বিবর্তন, রাজনীতি, সংগ্রাম-সাফল্য অনেক কিছুই রয়েছে আমার উপচে পড়া লেখার ঝুড়িতে। ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে লিডস শহরে কারি সেন্টার নামের একটি রেষ্টুরেন্টে টিন এইজে জীবনের প্রথম চাকরি শুরু করি। এরপর থেকে আমার জীবনটাই ‘কারি’র একটি থালায় সাজানো! আমি অনেক সময় জোক করে বলি ‘কারি ইজ লাইফ’! কম করে হলেও দেশে বিদেশে অন্তত পক্ষে হাজারের বেশি রেষ্টুরেন্ট পরিদর্শন করেছি। অনেক দিন থেকে জীবনের অভিজ্ঞতা, রেষ্টুরেন্টকেন্দ্রিক নানা ঘটনা, হাস্যরসের কথা, কারি লাইফ নিয়ে ১৭ বছরের পথ চলা এসব বিষয়ে লেখার ইচ্ছে থাকলেও নানা কারণে হয়ে উঠেনি। ‘কারি শেফ’ ম্যাগাজিনটি সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। লেখাগুলোকে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা, গল্প, না আত্মজীবনী বলবো সেটা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন।
সমবয়সী তেরাব আলীর হাত ধরে লিডস-এর মেরিয়ন ষ্ট্রিটের কারি সেন্টার রেষ্টুরেন্টে আমার আনুষ্ঠানিক চাকরি জীবনে পা রাখা। অনেকটা শিক্ষকের মতো সবকিছু শিখিয়ে দিলেন তেরাব আলী আমাকে। কিভাবে প্লেট ধরতে হবে, কিভাবে অডার্র নিতে হবে, কিভাবে কাস্টমারদের অভ্যর্থনা জানাতে হবে ইত্যাদি। সুবোধ বালকের মতো সবকিছু শিখে নেই এবং ভাবি কেন বিলেত এলাম! কেন বাবা মা এখানে নিয়ে এলেন। দেশে থাকলে জীবনের মোড় অন্যদিকে ঘুরতো। কোনো এক সময় মেনে নিলাম বাবা মা ভুল করেননি। তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই এই বিদেশ আসাটা বাংলাদেশের প্রতি দেশপ্রেম বাড়িয়েছে। আমরা প্রবাসীরা মনে হয় দেশের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তিত থাকি বেশি। সে যাক, বিলেত আসার মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই আমি রেষ্টুরেন্টে চাকরি শুরু করি। নতুন অ্যারাইভ্যালদের জন্য ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে কাজ ছাড়া এখনকার মতো অন্য কাজের সম্ভাবনা ও সুযোগ তখন একেবারেই ছিল না। ছিল না বর্তমানের মতো ফাষ্টফুড শপ বা সুপার মার্কেটে কাজের কোনো ব্যবস্থা। এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া ছিল একজন এশিয়ানের পক্ষে দুষ্কর। ব্রিটেনে প্রথম ম্যাকডোনাল্ড খোলা হয় ১৯৭৪ সালে, লন্ডনের উলউইচে। এখনতো নান্দোস, বাগার্র কিং, কেএফসিসহ বড় বড় ফ্রেঞ্চাইজের অভাব নেই। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যে কারো চাকরি পেতে তেমন বেগ পেতে হয় না। নতুন ইমিগ্র্যান্ট হিসাবে বিলেতে এসে আজকাল যে রকম ট্রেনিং, অ্যাপ্রেন্টিশিপ বা কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাও ছিল না আমাদের নতুন ইমিগ্র্যান্টদের জন্য। তাছাড়া তখনকার সময় বিলেতে যারা এসেছেন এবং বয়স ১৬-এর উপরে ছিল তাদের উপার্জনে লেগে যাওয়ার একটি টেন্ডেন্সি ছিল সব পরিবারে। ১৬ বছরের নিচে বয়স হলে বাধ্যতামুলকভাবে স্কুলে যেতে হতো। বর্তমানের অনেক সফল ব্যবসায়ী ও শেফদের কিন্তু স্কুল জীবনেই পার্ট টাইম ওয়াকার্র হিসাবে আত্মীয় স্বজনের রেষ্টুরেন্টে কর্মজীবনের হাতেখড়ি হয়েছে। আমি একটি কথা গর্ব করে বলতে পারি রেষ্টুরেন্টে কাজ করা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রেনিং গ্রাউন্ড। শুধু আমার নয় যারা ব্রিটেনে এসেছেন ষাটের দশকে, সত্তুর এবং আশির দশকে তাদের জীবনেও সবচেয়ে বড় ট্রেনিং গ্রাউন্ড-এর দায়িত্ব পালন করেছে এই রেষ্টুরেন্ট ইন্ডাষ্ট্রী। রেষ্টুরেন্টে কাজের মাধ্যমে তারা বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে এন্টারপ্রোনার হওয়ার স্পৃহা জাগায় এই কারি ইন্ডাষ্ট্রী। এতে কাজের মাধ্যমে তারা এদেশের জীবন ব্যবস্থা শিখেছেন, মানুষের সঙ্গে চলাফেরা, ইংরেজি শেখা, বিলেতের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনÑ সবকিছুর পেছনে রয়েছে এই কারি ব্যবসা। আজকে যাঁরা মুলধারার সঙ্গে ইন্টিগ্রেশনের কথা বলেন, এর প্রথম পাঠই হয়েছে রেষ্টুরেন্টে। অন্ততপক্ষে আমি গর্ব করে বলতে পারি এদেশের সমাজ ব্যবস্থা, মানুষ, সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষকে উপলব্ধি করা ও অহংকারী না হওয়া, শ্রমের মযার্দা দেওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে আমি যতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করেছি রেষ্টুরেন্টে কাজের মাধ্যমে আর কোনোকিছুর সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এজন্যে আমার পরিচিত যারাই ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নতুন এসেছেন তাদের সবসময়ই আমি এই উপদেশ দিয়েছি অন্য কোনো সুযোগ না থাকলে কিছুদিন রেষ্টুরেন্টে কাজ করুন। এতে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা নিজের সম্পর্কে যে অহংবোধ সেটি থাকবেনা, ইংরেজী ভাষায় দখল বাড়াতে পারবেন এবং এই কাজ জীবনে একটি স্টেপিং স্টোন হিসাবে কাজ করবে। ভবিষ্যতে এসব বিষয় নিয়ে আরও লেখার ইচ্ছে রয়েছে। সেই লিডস থেকে লিভারপুল, লিভারপুল থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে নটিংহ্যাম শেফিল্ড ইয়র্কশায়ার এসব স্থানে কাজের অপুর্ব অভিজ্ঞতা, তখনকার দিনের ট্রেন্ড, হাসিখুশির গল্প শেয়ারেরও ইচ্ছে রয়েছে।
যাই হোক ফিরে আসি আমার রেষ্টুরেন্টে কর্ম জীবনের শুরুতে। বয়স মাত্র আঠারো। অনেক স্বপ্ন সামনে। ভাল চাকরি করবো, সম্ভব হলে লেখাপড়া চালিয়ে যাবো। প্যারেন্টসও সেটি চাইছেন। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছি না। প্রথম সপ্তাহেই ডিপার্টমেন্ট অব সোশ্যাল সিকিউরিটিতে (ডিএসএস) গেলাম ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স কার্ড বের করার জন্য। বাবা নিয়ে গেলেন। এদেশে কর্মজীবন শুরুর পূর্বেই সেটি দরকার, এটা আমাদের সবার জানা। একই সঙ্গে আন-এমপ্লয়েড থাকায় বেনিফিটের জন্যও সাইন করে এলাম। প্রথম সপ্তাহেই বৃহষ্পতিবার বাসায় ডাকযোগে একটি বেকার ভাতার চেক পেলাম। মাত্র ৯ পাউন্ড। কি আনন্দ! আগে কী সুন্দর দিন ছিল! এখন মনে মনে ভাবি কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই আন-এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট। তখন এদেশের অর্থনীতিতে কানাকড়ির অবদান দেইনি আমি। তবে হ্যাঁ, যেহেতু অভিভাবক ট্যাক্স পেয়ার্স অর্থাৎ কর দিয়েছেন, সন্তান হিসাবে সেই বেনিফিটও আমি পেয়েছি। এখন প্রকৃতভাবে চাকরি নেই যেসব সাধারণ মানুষের, যাদের আর কোনো উপায় নেই, অসহায়, তাদের আন-এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট পেতে যে ঝামেলা পোহাতে হয় বা সামাজিক অপমানবোধের মাধ্যমে যেতে হয় সে কথা মনে হলে শিউরে উঠতে হয়।
পর পর তিন সপ্তাহ বেনিফিট নিলাম। প্রতি সপ্তাহে বৃহষ্পতিবার বাসায় ৯ পাউন্ডের সেই চেকটি কি না আনন্দ নিয়ে আসতো। তিন সপ্তাহের মধ্যেই এক আত্মীয় নুরুর রহমান এলেন আমাদের বাসায় সবাইকে দেখতে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, এখনই আমার কাজ শুরু করা দরকার। পরবর্তীতে কী করি না করি সেটা ভেবে-চিন্তে ঠিক করা যাবে। বাসায় বসে থাকা ঠিক নয়। নাহয় প্রথম জীবনেই আন-এমপ্ললয়মেন্ট বেনিফিট নেওয়ার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জীবনে। ব্যাস, সেই থেকে তাঁর রেষ্টুরেন্ট কারি সেন্টারেই আমার যাত্রা শুরু। রেষ্টুরেন্টে যারা কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। কয়েকদিনের মধ্যেই একে অন্যের বন্ধু হয়ে যান। একে অন্যকে সহায়তা করেন। তখনকার দিনে অধিকাংশ স্থানেই রেষ্টুরেন্ট থাকতো গ্রাউন্ড ফ্লোরে আর ফার্ষ্ট অথবা সেকেন্ড ফ্লোরে স্টাফদের বসবাসের জন্য থাকতো ফ্ল্যাট। স্বভাবতই এর ফলে তাদের আত্মিক সম্পর্কটা আরও গাঢ় হতো।
এখন টেকনোলোজি আমাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। অর্ধ শতাব্দি পূর্বে অনেকে ভাবতেই পারিনি প্রযুক্তি আমাদের এই অবস্থানে নিয়ে যাবে। কিচেনে অর্ডার লিখে পাঠানোর নোট প্যাডে যখন লিখলাম চিকেন কারি তখনই সহকর্মী তেরাব আলী হস্তক্ষেপ করলেন। আমি তো হতবাক কি হলো! বললেন এভাবে লিখবেন না। পুরো শব্দ লেখার দরকার নেই। কারণ কিচেনের কুক অথবা শেফ সেটা বুঝতে পারবে না। আপনাকে যেভাবে লিখতে হবে, অনেকটা শর্টার ভারশন। সিএইচ সিওয়াই। জানালেন, আপনার এই স্টাইলের লেখা ডিসের পুরো নামটি শেফ অথবা কুকের বুঝতে অসুবিধা হবে। রেষ্টুরেন্টে বিজি অর্থাৎ কাস্টমারে পরিপূর্ণ থাকলে ক্যাওস সৃষ্টি হতে পারে। বুঝলাম শর্ট হ্যান্ডের এই লেখাটাই বেশিরভাগ রেষ্টুরেন্টে প্রচলিত। তুলনা করে দেখুন এখনকার অবস্থা। প্রযুক্তি সব সহজ করে দিয়েছে। আইপ্যাড দিয়ে অডার্র নিচ্ছেন আর ইপস সিস্টেম থাকায় একযোগে কিচেন, বার সব জায়গায়ই তা প্রিন্ট হয়ে যাচ্ছে। এর উপকারিতা সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জানেন যারা এখন রেষ্টুরেন্ট পরিচালনা করছেন তারা। তবে একই সঙ্গে দুঃখও হয় চাকরিরর প্রতি দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকার, সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা, বন্ধুত্বের বন্ধন আগে যেমনটি ছিল এখন আর নেই। আমরা এটা হারিয়ে ফেলেছি। রেষ্টুরেন্টের কলিগদের বন্ধুত্ব এমন এক পর্যায়ে রূপান্তর ঘটতো যে, এর থেকেই জন্ম হতো তাদের ভবিষ্যত বিজনেস পার্টনারশিপ। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যে কারি ব্যবসার এই ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
অতীতে রেষ্টুরেন্টে যাঁরা কাজ করতেন, তা সে কিচেনে শেফ অথবা কুক এর পদ হোক অথবা সামনে ওয়েটার বা ম্যানেজার হন, এদের মধ্যে একটি এন্টারপ্রোনারশিপ স্পৃহা থাকতো। আগের দিনে রেষ্টুরেন্টে কর্মরত ওয়েটার, শেফ, কুক এমনকি কিচেন পোর্টারদের মধ্যে একটি স্বপ্ন থাকতো। তাঁরা একদিন নিজে রেষ্টুরেন্টের মালিক হবেন। নিজে রেষ্টুরেন্ট করবেন। সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন। অর্থ সঞ্চয় করতেন। এমনটি সচরাচর এখন কম দেখা যায়। এই যে এন্টারপ্রেনারশীপের স্পৃহা তা আগের মতো এখন আর নেই। অথচ রেষ্টুরেন্টের মালিকরা কিন্তু এই ইন্ডাষ্ট্রিতে কাজ করেই ব্যবসায়ী হয়েছেন। রেষ্টুরেন্টের বিভিন্ন পদে কাজ করে বিজনেস পার্টনার হয়েছেন তাঁরই এমপ্লয়ারের সাথে। আমার রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ী হওয়াটাও এরচেয়ে ব্যতিক্রমী কিছু ছিল না। ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মধ্যে এমন খুব কমই লোক দেখা যায় যারা রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন না অথচ শুধুমাত্র ইনভেষ্টর হয়ে রেষ্টুরেন্টের মালিক হয়েছেন। আর যদি এমন হয়েই থাকে তাহলে দেখা যায় পরবতীর্তে এই ইনভেষ্টর বা বিনিয়োগকারী সরাসরি রেষ্টুরেন্ট পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। কারণ এর মজাই আলাদা। আর্থিক বেনিফিটটাও অন্য চাকরি বা ব্যবসার চেয়ে অনেক বেশি। বিলেতে বাঙালির যত অর্জন সব কিছুরই উৎস কারি ব্যবসা। আর এই ব্যবসাকে অবজ্ঞা করলে অথবা নেতিবাচক আচরণের মাধ্যমে ঠেলে দিলে সেটি আর আমাদের দখলে থাকবে না। অর্ধ শতাব্দী বা তারও আগে যারা এই এন্টারপ্রেনারশিপ দেখিয়েছেন তাদের প্রতি আমার স্যালুট। এরাই কিন্তু তাঁদের কর্মীদের দেখাশোনা করেছেন, তাঁদের সঙ্গে রেখেছেন। বিজনেস পার্টনার করে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। একটি ব্যবসা থেকে চেইন রেষ্টুরেন্ট করেছেন। এমনও ব্যবসায়ী রয়েছেন যাদের ১৫টি, ২০টি করে পার্টনারশিপ ব্যবসা ছিল। তাঁরা মিলিওনার হয়েছেন।
আগের দিনে নতুন ব্যবসা খোলার জন্যে অফ এর দিন অর্থাৎ ছুটির দিনে রেষ্টুরেন্টের ওয়েটারদের কাজ ছিল নতুন ব্যবসা খোলার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করা। এক এক সপ্তাহে এক এক নতুন শহর বা নতুন ভিলেজ খুঁজে বের করা যেখানে কোনো ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট নেই। এভাবে সফর করে নতুন ব্যবসা খোলার মাধ্যমেই তারা সারা ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের পদচারণা বিস্তার করেন। বর্তমান ইন্ডাষ্ট্রি লিডাররা যতই নেতিবাচক কথা বলুন না কেন এটা চরম সত্য, ব্রিটেনের এমন কোনো ভিলেজ বা শহর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যেখানে কারি ব্যবসার জন্য বাংলাদেশিদের পদধুলি পড়েনি।
আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে অভিবাদন জানাই আমাদের পূর্বসূরী কারি লিজেন্ডদের। তাঁদের স্টাইল ও ঐতিহ্য আমরা কিছুটা হলেও ধরে রাখার চেষ্টা করি। তাদের পথ সামান্য হলেও অনুসরণ করলে ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তার কারণ থাকবে না।