কালের মন্দিরা

 

পার্থ প্রতীম মজুমদার
বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের পথিকৃৎ বিশ্বনন্দিত বাঙালি শিল্পী পার্থ প্রতীম মজুমদারের পরিচয় জানে না এমন বাঙালি খুব কমই আছে। তিনি কেবল বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় শিল্পী নন, তাঁর জনপ্রিয়তার সীমানা বিশ্বব্যাপী। দীর্ঘদিন প্যারিস প্রবাসী এই শিল্পীকে বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত করা হয় ২০১০ সালে। বিশ্ববিখ্যাত ফরাসী মূকাভিনেতা মার্সেল মার্সোর কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই শিল্পীকে সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সাংস্কৃতিক সম্মান ’শেভালিয়ে আর্ট এ লিটারেচার’ (যা ফরাসি নাইট উপাধি হিসাবে পরিচিত) ভূষিত করা হয় ২০১১ সালে। পার্থ প্রতীমের রয়েছে নানা পরিচয়। কেবল মূকাভিনয় নয়, সঙ্গীত, অভিনয়সহ শিল্পের নানা শাখা প্রশাখায় রয়েছে তাঁর বিচরণ। তাঁর অভিনীত এবং সদ্য সমাপ্ত একটি ছবি (যেটি সম্প্রতি প্রয়াত পশ্চিমবঙ্গের কীর্তিমান অভিনেতা সৌমিত্র চট্যোপাধ্যায় অভিনীত শেষ ছবি) বলিউডখ্যাত নাসিরুদ্দিন শাহ’র সঙ্গে অভিনীত পার্থ প্রতীমের অ ঐড়ষু ঈড়হংঢ়রৎধপু সদ্য মুক্তি পেয়েছে।
তাঁর অনেক পরিচয়ের আরেকটি পরিচয় হলো ভোজন রসিক হিসাবে এবং রন্ধন শিল্পের একজন কারিগর হিসাবেও পার্থ প্রতীমের বেশ সুনাম রয়েছে। একসময়ে মন্দিরা নামে প্যারিসের একটি বাঙালি রেস্তোঁরা বা রেস্টুরেন্ট পরিচালনায়ও তাঁর রয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি পার্থ তাঁর শিল্প এবং প্রবাস জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে রন্ধনশিল্পীদের এই ম্যাগাজিনে লিখবেন ধারাবাহিক রচনা ‘কালের মন্দিরা’।

প্রথম পর্ব

একজন শিল্পী হিসাবে আমি মনে করি খাবার-দাবার, আচার-আচরনে মানুষের কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ভিনদেশে এটা আরো বেশি নজরে পড়ে। খাবার দিয়ে বাঙালির বিশ্ব জয়ের অনেক ঘটনার কথা আমরা শুনতে পাই। আজকাল তো আমাদের উপমহাদেশীয় খাবার সারা বিশ্বে রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করছে। সেখানে আমাদের বাঙালিদের ভূমিকা খাটো করে দেখার নয়।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি একজন শিল্পী এবং শিল্পের এমন মাধ্যম গহণ করেছি, সেখানে কথা বলা বারণ। কেবল মূকাভিনয় করে মানুষের জীবনকাব্য তুলে ধরতে পারি এবং এই নিয়েই জীবিকা অর্জন করে বেঁচে আছি। সংস্কৃতিমনা কারি লাইফ ফুড ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রয়েছে আমার দীর্ঘদিনের পারিবারিক ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমার কথা বলা বারণ থাকলেও তারা আমাকে লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন তা-ও আমার রেস্টুরেন্ট পরিচালনার অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে। সেই সুযোগই বা হাতছাড়া করি কিভাবে?
কারি লাইফ সম্পাদক সৈয়দ বেলাল আহমেদ আমাকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, আমি প্যারিসে এক সময়ে মন্দিরা নামে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট চালাতাম, সেখানে তিনিও এসেছেন। তিনি আমাকে এই বলে বোঝালেন, মন্দিরা তো কেবল একটি রেস্টুরেন্ট ছিল না, এটা ছিল কালের মন্দিরা। এখানে কেবল সাধারণ ক্রেতাদের ভীড় ছিল না, আসতেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং সংস্কৃতিকর্মীরা। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্মী ও রাজনীতিবিদদেরও ছিল আনাগোনা। বেলাল আমাকে এই স্মৃতিগুলো নিয়ে লিখতে বাধ্য করলেন।
১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ ফ্রান্সে আমি ফরাসী একটি গ্রুপের সঙ্গে মাইম বা মূকাভিনয়ের একটি ওয়ার্কশপ করছি। আমার স্ত্রী জয়শ্রী মজুমদার এই গ্রুপের সদস্যদের দিনে দুবেলা ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের তালিম দেন।
দক্ষিণ ফ্রান্সের সামারের ফুরফুরে আবহাওয়ার কারণে সূর্য অস্ত যায় অনেক দেরিতে এবং হাতে থাকে দিনের অফুরন্ত সময়। যাই হোক টেলিভিশনের সুবাদে জানতে পারলাম আমার মূকাভিনয়ের গুরু প্রবাদপতিম মূকাভিনেতা মার্সেল মার্সো মস্কোর বলভেশিক থিয়েটারে একক শো করতে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মিতেরোঁ তাঁকে দেশে ফিরেয়ে আনার ব্যবস্থা করেছেন।
খবরটা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তিনি কেবল আমার মূকাভিনয়ের গুরু নন, গত কয়েক বছরে তাঁর সঙ্গে গুরু শিষ্য নয়, সম্পর্কটা অনেকটা পিতা-পুত্রের সম্পর্কে দাঁড়িয়েছে। তাঁর বাড়িতে আমাদের সপরিবারে আসা-যাওয়া। অনেক বিষয়ে তিনি আমারও মতামত জানতে চান।
এর পর খবর পেলাম, আমাকে কে ফোনে খুঁজছে। ফোন ধরতেই ওপ্রান্তে কন্ঠ শুনতে পেলাম অসীম রায়ের। দীর্ঘকাল প্যারিসে বসবাসরত বাঙালি অসীম রায় হচ্ছেন বাংলাসাহিত্যের দিকপাল ও বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ট বন্ধু। সুনীলদার বহু লেখায় তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর জনপ্রিয় বই ছবির দেশে কবিতার দেশের একটি অন্যতম চরিত্র অসীম রায়। আসীমদা জনাতে চাইলেন আমি কবে প্যারিসে ফিরছি?
প্যারিসে তখন আমি সস্ত্রীক শিল্পীদের এক হোষ্টেলে থাকি। প্যারিস শহরটি কুড়িটি কোয়ার্টারে বিভক্ত। প্যারিস শহরের চৌদ্দ নম্বর কোয়ার্টারে অসীম রায়ের একটি রেস্টুরেন্ট ছিল, যার নাম খরঃঃষব ঞৎবব। তাঁর এক শ্রীলংকান বন্ধু ও তাঁর ফরাসী স্ত্রী এই রেস্টুরেন্টটি চালাতেন।
আমি প্যারিসে ফিরতেই ডাক পড়লো তাঁর রেস্টুরেন্টে। অসীমদার কাছ থেকে শুনলাম তাঁর শ্রীলংকান বন্ধু ইউনেস্কোতে কাজ করতেন এবং তাঁর সুবাদে অনেক কূটনৈতিক ক্রেতা এই রেস্টুরেন্টে আসতেন এখন নানা কারণে তাঁর শ্রীলংকান বন্ধুকে ইউনেস্কোর চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। এখন এই ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে অসীমদা চিন্তিত এবং আমাকে দায়িত্ব নিতে বললেন।
রেষ্টুরেন্টের ব্যাপারে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, পড়ে জেনেছি আমার কথাটি অসীমদার কাছে বলেছেন প্রয়াত শুভেন্দু চৌধুরী। শুভেন্দু চৌধুরী ছিলেন অসীমদার বন্ধু এবং পেশায় একজন ফার্মাসিস্ট। তাঁর যুক্তি ছিল পার্থ প্রতিম শিল্পী মানুষ এবং তাঁর পাবলিক রিলেশনস ভাল এবং বর্তমানে সে ছুটিতে আছে, সে আপনার ব্যবসা বাঁচাতে পারে।
এই রেস্টুরেন্টের পাশেই ছিলো ফিল্মের স্পেশাল এফেক্ট তৈরি করার একটি স্টুডিও, যেখানে অনেক শিল্পী কলাকুশলীেেদ আনাগোনা ছিলো। শুভেন্দু চৌধুরীর যুক্তি ছিল, পার্থ যেহেতু একজন শিল্পী সে তাঁদের অনেকের সঙ্গে ভাব জমাতে পারবে যাতে ব্যবসার প্রসার হবে এবং পরবির্তিতে হয়েছিলোও তাই।
অসীম রায়ের অনুরোধে লন্ডনের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের অনেক পরিচিত মুখ ফারুক হায়দার এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেন। তাঁরা দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন লিটল ট্রি নাম পরিবর্তন করে এটাকে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট করা হোক। নতুন নাম করণ হলো মন্দিরা এবং সাজসজ্জায় পরিবর্তন আনা হলো। প্যারিসের বিখ্যাত প্রবীণ কুক আমিন চাঁদকে দায়িত্ব দেওয়া হলো কিচেনের। এই পরিবর্তনের ফলে ব্যবসা হয়ে উঠলো জমজমাট।
এই মন্দিরায় পরবর্তীতে বাঙালি-অবাঙালিসহ অনেক বিখ্যাত গুণীজনের পদধূলি পড়েছে। এই রেষ্টুরেন্টর সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় কত বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি তা লিখে শেষ করা যাবে না। এই কালের মন্দিরায় টুকরো টুকরো স্মৃুতিগুলো পাঠকদের সামনে তুলে ধরার ইচ্ছা রইলো।

Share it in social media


আরও খবর