তথাকথিত ষ্ট্রীট ফুড বা পথের খাবারকে নিয়ে এত হৈচৈ কেন?

 

কারি ইন্ডাষ্ট্রিতে একটি নতুন ট্রেন্ড এখন যেখানেই যাবেন অনেক গাভনার সাহেব বলবেন ভাইসাব আমার নতুন কনসেপ্ট হলো ষ্ট্রীট ফুড। অথবা বলবেন গ্রীল ফুড। এও বলতে ভুলেন না হেলদি খাবার হলো গ্রীল ফুড! ৪০ বছর পূর্বে ‘লাগার লাউট’ বা লেট নাইটের কাস্টমারদের যে খাবার পরিবেশন করেছেন সেখান থেকে কারি অনেক উচ্চতায় উঠে এসেছে। খাবার সম্পর্কে বেশিরভাগ শেফ ও রেষ্টুরেন্ট মালিক এখন অনেক সচেতন। শেফদের খাবার হেলদি ও উন্নত মানের। এর অন্যতম কারণ হলো শেফরা এখন ট্রেনিং প্রাপ্ত, হাইজিন রেটিং বুঝেন, সৃজনশীল হওয়ার আকাংখা এবং পেশা হিসাবে শেফ এর সম্মান উচ্চতায় ইত্যাদি।
কিন্তু ইদানিং নিজেদের সুন্দর অভিজাত রেষ্টুরেন্টে ট্রাডিশনাল মেনু সম্পুর্ণ ত্যাগ করে সস্তা পথের খাবার বিক্রির ট্রেন্ড শেফদের পিছনে নিয়ে যাচ্ছে। কপি করতে গিয়ে তাদের উদ্ভাবনি শক্তি লোপ পাচ্ছে।  এমনও দেখা যাচ্ছে কিছু রেষ্টুরেন্ট ষ্ট্রীট ফুডের মেনু চালু করে ব্যর্থ হয়ে আগের ব্রিটিশ কারিতে ফিরে যাচ্ছে। ষ্ট্রীট ফুড বা পথের খাবার নিয়ে লিখেছেন প্রতিবেদক।

একটা কথা আছে, যে যেটা পারেন সেটাতেই ভালভাবে মনোযোগ দিলে উচ্চতার শিখরে পৌছা যায় সহজে। এর থেকে মনোযোগ সরে গেলে আপনার ধ্বস নামতে পারে। যাই করি আমাদের ভেবে চিন্তে করা উচিত। এমন কি নতুন কোন উদ্যোগ বা চ্যালেঞ্জ নিতে গেলেও সঠিক প্ল্যান নিয়ে অগ্রসর হওয়া ভাল। অন্যথায় সঠকে পড়তে হয়। আমার এই লেখা কোন ব্যক্তি বা ব্যবসাকে খাটো বা হীন করে দেখার জন্যে নয়, বরং আমার পর্যবেক্ষণই বলা চলে। কারি ইন্ডাষ্ট্রীতে যারা ব্যবসা করছেন তাদের স্যালুট দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। নানা সমস্যার মধ্যে যে তারা এই ব্যবসা ধরে রেখেছেন বা এগিয়ে নিচ্ছেন এর জুড়ি মেলা ভার। তবে ইদানিং কালের কিছু ট্রেন্ড আমাকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তুলে!
বিষয়টি হলো ষ্ট্রীট ফুড অর্থাৎ পথের খাবার। পথের খাবারকে সাজিয়ে গোছিয়ে এনে অভিজাত পরিবেশে পরিবেশন করা। মায়ের খাবার ত্যাগ করে রাস্তার খাবার নিয়ে হৈ চৈ। আমাদের শেফ যারা সুনাম অর্জন করেছেন তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন তাদের অুনপ্রেরণার উৎস কে, তারা অকপটে বলবেন তাদের মা। অর্থাৎ তাদের কাছে মায়ের খাবারের চেয়ে শ্রেষ্ট কিছু নেই। ইদানিং মায়ের খাবার ত্যাগ করে রেষ্টুরেন্টগুলোর পথের খাবার অর্থাৎ ষ্ট্রীট ফুড নিয়ে হাল্লাগোল্লা খুব বেশি। আর এতে ব্যবসায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অনেকের।
তথাকথিত পথের খাবার বা ষ্ট্রীট ফুড হতে সতর্ক থাকুন। বাপ-দাদার আমল থেকে প্রচলিত, পরিক্ষিত এবং কাস্টমারদের কাছে জনপ্রিয় ট্রাডিশনাল ব্রিটিশ কারির জনপ্রিয়তার হিংসায় অনেক ভারতীয় নব্য রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা নতুন মেন্যু আইডিয়া আমদানী করেছেন। তা হলো ভারতীয় স্ট্রীট ফুড বা পথের খাবার। আমাদের অনেক ব্রিটিশ বাংলাদেশী কারি হাউসগুলো এইসব চমক দেখে ট্রাডিশনাল কারি হাউসের পপুলার খাবার পরিবেশন ত্যাগ করে এখন পথে বসেছেন। ব্যবসা একবার পড়ে গেলে তোলা বড় কঠিন ব্যাপার। নিজেরা যেটায় অভ্যস্ত সেটা না করে যে কেউ এসে নতুন কিছু ধরিয়ে দিলেন আর সেটা গ্রহণ করা যে কত বড় ঝুকিপূর্ণ হতে পারে সেটা কি কেউ উপলব্দি করেছেন? এই মহামারির সময়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যারা ষ্ট্রীট ফুড নিয়ে হম্বিতম্বি করেছেন সেসব রেষ্টুরেন্টই সাফার করেছে বেশি। অন্যদিকে একটি সাধারণ টেকওয়েও যারা ট্রাডিশনাল কোরমা, ভিন্দালু বিক্রি করেছে তারা ভাল ব্যবসা করেছে। মানুষ পানি পুরি অথবা চানাচুর চাটের জন্য টাকা খরচ করতে চায়নি। বিশেষ করে সিটিতে এসব ব্যবসার বেহাল অবস্থা হয়েছে।
ভারতীয় স্ট্রীট ফুড বলতে আমরা কি বুঝি? সাধারণত এগুলো হলো বোম্বে, দিল্লী, আহমেদাবাদের রাস্তাঘাটে ফেরিওয়ালারা নোংরা পরিবেশে যেসব গরীব মেহনতি মানুষের জন্য পাও (বনরুটি)ভাজী, চাট মশালা, পানিপুরি, সমোসা চাট ইত্যাদি পরিবেশন করে সে টাইপের খাবার। কর্মজীবি মানুষেরা রাস্তায় দাড়িয়ে এসব খাবার খান। এতে দোষের কোন কিছু নেই। কোটি কোটি মানুষ এই খাবার খাচ্ছেন। আমাদের উপমহাদেশের জন্য তা ঠিকও আছে। বিলেতেতো রাস্তায় দাড়িয়ে এরকম খাবার খাওয়া যায়না। কিছু ইন্ডিয়ান এসব খাবারের মধ্যে সামান্য আধুনিকতার পরশ এনে ষ্ট্রীট ফুড নাম দিয়ে লন্ডনের টুরিষ্ট এলাকার রেষ্টুরেন্টগুলোতে তা বিক্রি করছেন। তাও আবার চড়া দামে। সে হিসাবে হট ডগ, বা রাস্তায় ট্রলিতে করে যারা বার্গার বিক্রি করেন সেটাও স্ট্রীট ফুড।
আমরা জানি আমাদের বাংলাদেশে এবং কলকাতায় এসব ষ্ট্রীট ফুড আছে। কিন্তু তার পরেও এটার একটা মান আছে। এটা ওখানকার মানুষের জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু এখানে রেষ্টুরেন্টে এটা চলবেনা এবং যারা চালু করেছেন তারা হার মানতে বাধ্য হয়েছেন। এটা অত্যন্ত অনুতাপের যে মেইনষ্ট্রীম মিডিয়ায় কিছু পিআর কোম্পানীর সহযোগীতায় আমাদেরই নতুন প্রজন্মের কিছু ছেলে মেয়ে ব্যবসায়ী বাপ – দাদার শ্রমে ঘামে গড়া ব্যবসা কারি রেষ্টুরেন্টদের নাক সিটকান। তারা ব্যবসায় কোন পরিবর্তন আনতে চান না বলে ভৎসর্ণা করেন আর নিজেরা পথের খাবার বিক্রি করে এক্সপার্ট বলে জাহির করেন। তারা ভুলে যান এই বয়স্করা তাদের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করেছেন বলে তারা ব্যবসা করছেন। স্পর্ধাই বলা চলে।
প্রায় শত বছর ধরে ব্রিটেনের কারি হাউসগুলোতে যে উন্নত মানের খাবার বিক্রী বা পরিবেশন করা হচ্ছে তার তুলনায়, এসব ষ্ট্রীট ফুডকে ঠিকই পথ ঘাটের খাবার বলা যায়। এটা খেয়ে কি কোন ব্রিটিশ কাস্টমারের পেট ভরবে? ভেবে দেখুন? এই জন্য এসব নব্য ভারতীয় রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা মার খাচ্ছেন ব্যবসায়। এটাই হলো আমাদের কারি হাউসের ব্যবসার সবচেয়ে বড় সিক্রেট বা রহস্য।
আর দু:খজনক হলো কিছু বাংলাদেশী বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের অনেকে এসব গিমিকে বিভ্রান্ত হয়ে রেষ্টুরেন্টের মেন্যুতে কোন নতুনত্ব বা পরিবেশনায় বৈচিত্র না এনে এসব তথাকথিত ষ্ট্রীট ফুডের দিকে আকর্ষিত হচ্ছেন। এটা মূলত ব্যবসার ব্যাপারে তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে। এসব তরুণ ব্যবসায়ীরা কখনো বোম্বে, আহমেদাবাদ, দিল্লীর রাস্তায় কি ভাবে এই ফুড বিক্রি হয় জীবনে দেখেনি। অথচ দেখুন রেষ্টেুরেন্টে ঢুকেই কাষ্টমার চায় টিক্কা মশলা, মাদ্রাজ, দোপিয়াজাঁ, রগন জোশ। এসব ট্রাডিশনাল কারি হাউস মেন্যূকে আরো উন্নত এবং পরিবেশনায় আনা যায় নানা বৈচিত্র। কিন্তু কেন আমরা এটা করছিনা।
আমাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা ধরনের খাবার আছে। সাতকড়া মাংসের বাইরে আমরা কি কিছু খাইনা? আমাদের বুঝতে হবে অনেক কাষ্টমার কেন ষ্টাফ কারি খেতে চায়? এর কারণ হলো আমরা নিজেদের জন্য বা ষ্টাফদের জন্য যা তৈরী করি এর মধ্যে বৈচিত্র আছে।
ইয়র্কশায়ারে শেফিল্ডের পাশে একটি ছোট শহরে এক বিশাল বিল্ডিং নিয়ে এক ভারতীয় অত্যন্ত আধুনিক একটি রেষ্টুরেন্ট খুলেন কিছুদিন আগে। তার মেন্যূর প্রাধান্য হলো ভারতীয় ষ্ট্রীট ফুড এবং খুব গর্ব করে এ নিয়ে স্থানীয় মিডিয়ায় রেষ্টুরেন্ট খোলার আগে বেশ প্রচারণাও চালান। প্রতিবেদককে জানালেন ভাই কাস্টমার এসেই বলে চিকেন মাদ্রাজ অথবা জালফ্রেজি আছে কিনা। এখন এ নিয়ে তাদের ষ্ট্রাগল করতে হচ্ছে, এবং কাস্টমারের ডিমান্ড পূরণে খাবারের প্রশ্নে সেই পুরানো মেন্যুতে যেতে হচ্ছে।
সাউথ লন্ডনের একটি রেষ্টুরেন্ট ইন্ডিয়ান ষ্ট্রীট ফুড নিয়ে বন্ধু ব্যবসায়ী মহলে এতোই লাফালাফি করলেন যে তা নজর কাড়ার মতো। অথচ রেষ্টুরেন্টটি এর আগে ট্রাডিশনাল খাবার নিয়ে ভালই ব্যবসা করে যাচ্ছিল। ভাবখানা এমন ছিল যে মালিক নিজেই এই ষ্ট্রীট ফুড আবিস্কার করেছেন। রেষ্টুরেন্টের আদলও পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন টেবিল ক্লথ তুলে রাস্তার বেঞ্চ এর মতো কাঠের আসন দিয়ে। ভারতীয় একটি মানচিত্রও লাগাতে ভুলেন নি দেয়ালে। কিন্তু তার এই ধারণাও হয়তো ছিলনা সে দিন এখন চলে গেছে, ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে তাজ মহল, কোহিনুর নাম রেখে এবং সামনে মুর্তি বা ম্যাপ টাঙ্গিয়ে বুঝাতে হয়না এটি ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, বেঞ্চি কাঠের টুল ফেলে তিনি আবার টেবিল ক্লথে ফিরে গেছেন এবং ব্যবস্ াভালই করছেন। কাস্টমার ডিমান্ড সম্পর্কে উপলব্দি ঘটেছে।
প্রবীণ একজন ক্যাটারার্স মন্তব্য করলেন, আমরা রেষ্টুরেন্ট করলাম অনেক অর্থ ব্যয় করে। উন্নতমানের ডেকোরেশন, টেবিল চেয়ার, আসবাব পত্র, ঝাড়বাতি, ইত্যাদি ইত্যাদি যোগ করলাম। আর বিক্রি করবো রাস্তার খাবার? এটা কেন? তাহলে রাস্তায় একটা স্টল নিয়ে বোম্বের মতো বসে পড়ি, কি বলেন?
তিনি বলেন, ‘‘এরকম ফটকাবাজি করে আমরা ব্যবসা হারাচ্ছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা এই ব্যবসা ভালো বুঝতেন। তারা কাষ্টমার রেষ্টুরেন্টে পা দেবার আগে দেখতেন এর পড়নে জিনস বা ট্রেইনার আছে কি না? অনেক কাষ্টমারদের এসব কারণে দোকানে ঢুকতেও দিতেন না। রেষ্টুরেন্টে আমরা ঝালমুড়ি চানাচুর বিক্রির পথে না গিয়ে, আরো ভালো এবং উন্নত খাবার কি ভাবে পরিবেশন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে পারি। যদি কারো কপি বা অনুকরণ করতে হয়, তাহলে আমরা ভালোটা করবো। সস্তা জিনিষ দিয়ে ব্রিটিশদের মন ভোলানো যাবেনা। এই যেমন ধরুন আমরা দেখেছি রাস্তার টি স্টলে বসে কেউ সামান্য আচার দিয়ে একটা রুটি বা পরোটা খেয়ে নিলো। এটা হতে পারে নানা কারণে, আমি এটাকে খারাপ বলছিনা। কিন্তু এটার জন্য এতো খরচ করে রেষ্টুরেন্ট খোলার প্রয়োজন নেই। রাস্তার খাবার রাস্তায় বিক্রির জন্য রাস্তায় বসে পড়লেই ভাল নয়কি?”

যেভাবে ষ্ট্রীট ফুড, গ্রীল ফুড আর ফ্রাই চিকেন পিজার দিকে আমরা অগ্রসর হচ্ছি এটা খুব সুখের খবর নয়। যেকোন ব্যবসাতে ভাল উপার্জন করে সফল হলে আপত্তি নেই। তবে বিলেতের বাঙালিরা সবকিছুতেই দ্বিগুন হুজুগে। একজন একটা করলে পরিণতি যাই হোক অন্যরাও তা করতে থাকেন। যেভাবে গ্রীল ফুড, ষ্ট্রীট ফুড, ফাষ্টফুড এর দিকে ধাবিত হচ্ছি পরবর্তীতে শ্যাম ও নাই কুলও নাই অবস্থা না হলেই ভাল।

Share it in social media


আরও খবর