কারি শিল্পের যুবরাজদের কাহিনী (পর্ব -3)

-- সৈয়দ বেলাল আহমেদ  
 

জিন্নাহ নাম পাল্টে রেষ্টুরেন্টের মুজিব নামকরণের গল্প

বিলেতের কারি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বাঙালি শেফদের দেশপ্রেমের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। কারি লাইফ সম্পাদনা এবং নিয়মিত ফুড ফেস্টিভ্যাল করতে গিয়ে অনেক বাঙালি ও অবাঙালি শেফের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বাঙালি শেফদের মধ্যে খাবার নিয়ে শুধু উৎসাহ নয়, যে দেশপ্রেম দেখেছি তা জীবনে ভুলবার নয়।
সমগ্র বাঙালি জাতি যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষ পালন করছে, সেই মুজিববর্ষে একজন মুজিবপাগল শেফ এর গল্প বলতে চাই। কিভাবে একজন ব্রিটিশ বাঙালি শেফ পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামের একটি রেষ্ঠুরেন্ট কিনে রাতারাতি এটাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করেন সেই অজানা কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরব। অভিজাত এই রেষ্টুরেন্টটি ছিল পাকিস্তানি একটি রেষ্টুরেন্ট চেইন জিন্নাহ গ্রুপের অত্যন্ত ব্যস্ত ব্যবসা সফল ‘জিন্নাহ রেষ্টুরেন্ট’। প্রায় দুই যুগ আগে এই রেষ্টুরেন্টটি কিনে সেই মুজিব পাগল ব্যবসার পরিণতি খারাপ হতে পারে তা চিন্তা না করে হুট করেই ‘মুজিব’ নাম রেখে ফেলেন। শুধু তাই নয় তাঁর খাবারের ডিশগুলোর নামও রাখেন চমৎকার ।
এই ধারাবাহিক লেখার গত পর্বে তুলে ধরেছি জনপ্রিয় বাঙালি লেখক শংকরের (মনি শংকর মুখার্জী) কথা। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ব্রিটিশরা যারা একসময় আমাদের ভারতবর্ষ শাসন করেছে তারা আমাদের এই বাঙালিদের তৈরি খাবারের কাছে রীতিমত আত্মসমর্পণ করেছে। কথাটা মোটেই ফেলনা নয়। আমরা যখন কারি লাইফের এই ফুড ফিস্টিভ্যাল টিম নিয়ে কলকাতা যাই, তা আরেক বিখ্যাত বাঙালি লেখকের নজর কেড়েছিল। তিনি হচ্ছেন বিশিষ্ট কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ২০০৬ সালের কলকাতায় অনুষ্ঠিত আমাদের ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে তিনি একটি বাণী দিয়েছিলে। তার ঐতিহাসিক গুরত্ব অনুভব করে এখানে তুলে ধরলাম। শুধু তাই নয়, তিনি আমাদের ব্রিটিশ কারি ফেস্টিভ্যালের আতিথেয়েতাও গ্রহণ করেছিলেন।


আরেকটু পিছন থেকে আলোচনাটা শুরু করি। প্রতিটি ফেস্টিভ্যালের জন্য আমরা শেফ বাছাইয়ের আগে তাঁদের যোগ্যতা, রন্ধনশিল্পে তাঁদের পারদর্শিতা যাচাই-বাছাই করে আমাদের টিম তৈরি করতে হয়। এই নিয়ম আমরা এখনো মেনে চলি। আমাদের, অর্থাৎ ফেস্টিভ্যালের নীতিনির্ধারকদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ কারণে ভ্রমন করতে হয় এবং শেফদের তৈরি খাবার শুধু টেস্ট করা নয়, পরিবেশনাসহ নানা দিক বিবেচনা করতে হয়। তাঁদের নিজস্ব বেশভুষা, পারসোন্যাল হাইজিন ও প্রেজেন্টেশনও দেখতে হয়। পাঁচতারকা হোটেলে ব্রিটিশ খাবারের প্রমোশন করতে আমাদের টিপটপ থাকাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৫ সালের জন্য ঢাকা শেরাটন হোটেলে অনুষ্ঠিত ফেস্টিভ্যালের এক শেফ বাছাই করতে আমরা হাজির হই ইয়র্কশায়ারের একটি অত্যন্ত সুন্দর শহর হ্যারোগেটে। স্প্রিংওয়াটার স্পার জন্য বিখ্যাত এই শহরটি ব্রিটেনে ট্যুরিষ্টদের একটি স্বর্গ বলা চলে। লাখ লাখ মানুষ প্রতিবছর এই শহরে রেড়াতে যান। হ্যারোগেইট শহর এবং এর আশে পাশে ব্রাডফোর্ড, লিডস ইত্যাদি শহরে পাকিস্তানি রেষ্টুরেন্টের আধিপত্য বেশি। কাশ্মীরি এরোমা, আগ্রা, আকবর, শাহবাব, জিন্নাহ ইত্যাদি নামের বড় বড় রেষ্টুরেন্ট চারিদিকে।
হ্যারেগেইট শহরে একটি জনপ্রিয় রেষ্টুরেন্ট হলো জিন্নাহ। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামে পুরো ইয়র্কশায়ার জুড়ে চেইন রেষ্টুরেন্টের একটি হলো এটি। আমাদের আকর্ষণের কারণ হলো এই রেষ্টুরেন্ট কিনে নিয়ে আমাদের এক বাঙালি শেফ তাঁর নাম রেখেছেন মুজিব। অবশ্যই তার খাবারেরও গল্প শুনেছি। এই সৃজনশীল শেফের মেন্যুর ডিসের কথা শুনে আমাদের আরও আগ্রহ বেড়ে যায়। রাতারতি জিন্নাহ থেকে মুজিব রেষ্টুরেন্টের প্রতিষ্ঠাতা শেফ ও সফল ব্যবসায়ীর নাম হলো মর্তুজ আলী ওরফে নজরুল ইসলাম। তাঁর এই দেশপ্রেমে আমরা অভিভুত মুজিব রেষ্টুরেন্ট দেখতে গিয়ে আমরা মোটেই হতাশ হইনি। আমরা জানতাম না আমাদের জন্য কী চমক অপেক্ষা করছে।
নজরুল ইসলাম কেবল মুজিব প্রতিষ্ঠা করেননি, সাথে সাথে রীতিমত বৈপ্লবিক পরবির্তন এনেছেন তার মেন্যুতে। তাঁর মেন্যুটি বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি নেতানেত্রী এবং আমাদের কৃষ্টির প্রতি উৎসর্গকৃত একটি দলিল বলা যায়। এখানে কেউ বাদ যাননি। এখানে জয় বাংলা ও মুক্তিবাহিনী দিয়ে স্টার্টার যেমন আছে। তেমনি আছে মওলানা ভাসানীর প্রতি উৎসর্গ করা ডিস। আছে শেরেবাংলা ও কবিগুরুর নামে উসর্গীকৃত ডিস ও তার বিবরণ। অল্প কথায় বলব, অসাধারণ দেশপ্রেমের ছাপ, প্রতিটি স্তরে। পরে জানতে পারি, নজরুল কেবল শেফ নন, পার্শ্ববর্তী ব্রাডফোর্ড শহরের স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন কর্মীও। তাঁর ব্যবসা বাণিজ্য এবং সব কিছুতেই দেশপ্রেমের ছাপ ফুটে ওঠে।


নজরুলকে আমরা ফেস্টিভ্যাল টিমের সদস্য করতে রাজি হই। তবু নজরুল এই ফেস্টিভ্যালে যোগ দেওয়ার আগে একটি শর্ত জুড়ে দেন। তা হলো, তাঁর ইচ্ছা ঢাকায় শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করা, এবং মুজিব রেষ্টুরেন্টের একটি মেন্যু হস্তান্তর করা। যদিও বাংলাদেশে তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতাসীন এবং বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী, আমি তাঁর এই শর্ত মেনে নেই। আমি যদিও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই, এটা আমার জন্য ছিলো বিশেষ চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আত্মবিশ্বাসও ছিল। শেখ হাসিনা গণমানুষের নেত্রী। জনসাধারণ তাঁর কাছে যেতে পারে। এটা তাঁর বিশেষ গুণ। আমি আশ্বস্ত ছিলাম আমি পারব। তাঁকে এই আশা দেই চেষ্টা করবো।
এই প্রসঙ্গটি আরেকটু খোলাসা করে বলতে চাই। বাংলাদেশের রাজনীতি তখন নানা কারণে দ্বিধাবিভক্ত। সবকিছুতে দলীয়করন। যে হোটেলে আমাদের ফেস্টিভ্যাল হচ্ছিল সেটা যদিও শেরাটন, কিন্তু সরকার পরিচালিত। সরকারের মন্ত্রী (বিমান ও পর্যটন) আমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একজন অতিথি। আর আমার একজন শেফের আকাঙ্ক্ষা হলো দেশের বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার। জানাজানি হলে এটি আমার জন্য বিব্রতকর হতে পারে। হোটেল কর্তৃপক্ষ হয়তো বেঁকে বসবে এবং অযথা ঝামেলা হবে।
আরেকটি ঝামেলা হলো, শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য কাকে বলি। যাই হোক, সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমি তাঁকে বিষয়টি খুলে বললাম এবং তাঁর সাহায্য চাইলাম।
পরদিন নাহিদ ভাই ব্যবস্থা করলে হোটেল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ফেস্টিভ্যালের কর্তাব্যক্তিরা গোপনে নজরুলকে নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সুধাসদনে দেখা করতে যাই। নাহিদ ভাইয়ের সহযোগিতায় নজরুলের স্বপ্ন পুরণ করতে সক্ষম হই। নজরুলকে দিয়ে শেখ হাসিনার হাতে মুজিব রেস্টুরেন্টের মেন্যুটি পৌঁছে দিতে সক্ষম হই। মানুষের নেত্রী শেখ হাসিনাও আমাদের সবাইকে সাদরে গ্রহণ করেন। জিন্নাহ থেকে মুজিব নামকরণের কাহিনীটাও আমরা সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনাকে বলতে পারি।
শেফ নজরুল ইসলাম পরবর্তীতে মুজিব রেষ্টুরেন্টের আরেকটি শাখা খোলেন এলসমেঢয়ার পোর্ট নামে লিভারপুলের পাশ্ববর্তী একটি শহরে। অত্যন্ত সৃজনশীল এই শেফ ইয়র্কশায়ার পুডিং দিয়ে কারির সঙ্গে একটি ফিউশন ডিস তৈরি করে ঢাকায় ফেস্টিভ্যালে পরিবেশন করেন। ব্যাপক প্রশংসা পায় ডিসটি। ইয়র্কশায়ারে বিবিসি টেলিভিশনও তাঁর এই ডিসটি একটি সংবাদে দেখায়। পরবর্তীতে কারি লাইফের পক্ষ থেকে শেফ নজরুল ইসলামকে তাঁর সৃজনশীলতার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বেষ্ট শেফ অ্যাওয়ার্ডও দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ কি জানে অথবা বাংলাদেশের নেতানেত্রীরা কি জানেন, প্রতিটি বাংলাদেশী শেফ এবং প্রতিটি বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টকর্মী কি আন্তরিকভাবে তাঁদের মনে একটি মিনি বাংলাদেশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের কেউ কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বা কোনো সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এদেশে কাজে আসেননি। মায়ের হাতের রান্না পুঁজি করে এখানে এক একজন শেফ তৈরি হয়েছেন। এরাই বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠান এবং এরাই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন। এই প্রবাসীদের নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ সুবিধা আদায় করে নেয়।
কথাটা বলতে দুঃখ হচ্ছে, কারি শিল্পের এই যুবরাজ নজরুল ইসলাম, যিনি তাঁর অগাধ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানীদের হাত থেকে জিন্নাহ রেষ্টেুরেন্ট কিনে এটাকে আমাদের মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে নামকরণ করেন, তাঁকে বাংলাদেশে তাঁর পৈত্রিক সম্পদ উদ্ধার করতে গিয়ে নানা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অনেকটা সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে।

Share it in social media


আরও খবর