কারি শিল্পের যুবরাজের কাহিনী

-- সৈয়দ বেলাল আহমদ  
 

রান্না করা হলো একটি আর্ট।আর এই আর্ট অর্থাত্‌ শিল্পের কারিগরদের বলা হয় রন্ধন শিল্পী। এই শিল্পীদের নিয়ে এবং রন্ধন শিল্পের অনেক ভালমন্দ, ঐতিহ্য এসব নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন কারি শেফ ম্যাগাজিনের সম্পাদক সৈয়দ বেলাল আহমেদ।
বাংলাদেশের দুজন অত্যন্ত স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবির কথা দিয়ে শুরু করছি। একজন সম্প্রতি প্রয়াত বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আরেকজন গত হয়েছেন বেশ আগে। অধ্যাপক ও কবি সৈয়দ আলী আহসান। দুজনের খ্যাতী ছিলো শিল্প সমালোচক হিসাবে। বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের পরিচিতি ছিলো প্রগতি ধারার লেখক ও শিল্প সমালোচক হিসাবে, কিন্তু সৈয়দ আলী আহসানকে আবার অনেকে বিপরীত ধারার মনে করতেন।
আমি যদিও নিজেকে প্রগতি ধারার একজন বলে মনে করি, তবে একবার সৈয়দ আলী আহসানের রান্নাবান্নার উপর এক বক্তব্য শুনে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই। কেউ যে এটাকে একটা শিল্প হিসাবে মনে করতে পারে তা ছিলো আমার কল্পনার বাইরে।
তিনি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে যুক্তি দিয়ে এটাকে রন্ধন শিল্প হিসাবে উপস্থাপন করেন। কবি সৈয়দ আলী আহসান (আমার কাছে তার কবি পরিচয়টা বড়)। বাংলাদেশের বাবুর্চি পেশাকে তিনি একটি খুব উচ্চচতরের পেশা হিসাবে সম্মানের সাথে তুলে ধরে বলেন যারা রান্না করেন তাদেরকে ‘আমাদের বাবুর্চি বলা উচিত নয়। তারা আসলে রন্ধনশিল্পী। আর রান্না করা হলো একটি আর্ট।’
পরবর্তিতে জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বিলেতের বাংলাদেশীদের পরিচালিত বিশাল রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা দেখে (যা এখানে কারি ব্যবসা হিসাবে পরিচিত) আমারও ধারণা হয়েছে আসলেই এটা একটি শিল্প এবং এখানে এই শিল্প কালিনারী আর্টস হিসাবেই স্বীকৃত। আমার এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন বিলেতের বিশাল কারি শিল্পের সাথে জড়িত নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী যুবরাজদের নিয়ে। সেই অর্থে এই প্রতিবেদনের নাম রন্ধন শিল্পের যুবরাজদের কাহিনীও বলা যেতে পারে।
বিলেতে আসার সুবাদে এবং রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায় জড়িত হবার সূত্রে দেখেছি আমাদের বাঙালি ছাড়া সবাই এই পেশাকে কালিনারী আর্ট হিসাবে সম্মান করে। এখন দেখতে পারছি নতুন প্রজন্মের কাছে এই শিল্প অবহেলিত এবং অনেক বাঙালী রন্ধনশিল্পীদের পেশার প্রতি তেমন কোন আগ্রহ নেই। অথচ এটাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়ে কিন্তু অনেকদুর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এর কিছু প্রমাণ আপনাদের কাছে আমি তুলে ধরবো।
ব্রিটেনে কারি ব্যবসায় এখন যারা রন্ধনশিল্পের সাথে জড়িত তাদেরকে এখন সম্মানের চোখে দেখা হয় এবং তাদের কদরও অনেক বেড়ে গেছে। এটা সম্ভব হয়েছে অনেক চাপে পড়ে। থ্যাংকস টু কারি লাইফ ম্যাগাজিন ও আমাদের বিরামহীন ক্যাম্পেইন। কারি শেফরা যে এই ব্যবসার মেরুদন্ড এখন অনেক গাভনার (ইংরেজী উচ্চারন হলো গভর্নর) বা মালিকরা বুঝতে পেরেছেন। রেষ্টুরেন্ট মালিকদের এখানে গভর্নর বা চলতি উচ্চারণে গাভনার বলা হয়।
অনেক গাভনার ব্যবসার সার্থে শেফদের পার্টনারশীপ বা অংশিদারিত্ব দিয়ে থাকেন। শেফ সংকটের কালে এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে তার চেয়েও আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারলে এবং সময় উপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে আমাদের কারি হাউসের স্টাফ সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হতো। সেটা নিয়ে আলাদা ভাবে লিখতে চাই।
অনেকে দেশ বিদেশে কারি কলেজ খুলে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা অবশ্য নির্ভর করে তাদের উদ্দেশ্যের উপর। কারো উদ্দেশ্য থাকে আমাদের উপমহাদেশ থেকে ট্রেনিং দিয়ে লোকবল এনে আমাদের এখানকার সমস্যার সমাধান করা, আবার কারো উদ্দেশ্য থাকে সরকার থেকে আর্থিক অনুদান নিয়ে সমস্যার সমাধান করার। এটা যার যার ব্যাপার। আমি মনেকরি এই বৃত্তের বাইরে আমাদের সমাধান খুজতে হবে।
কারি লাইফ ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠার পর থেকে কারি লাইফ শেফ এয়ার্ড এবং সমগ্র বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ স্টাইলের কারি ফেষ্টিভ্যাল করার সুবাদে আমার শত শত শেফের সাথে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমার ধারাবাহিক এই কাহিনী হলো তাদের নিয়ে। সাথে সাথে এই কারি শিল্পের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথাও তুলে করতে চাই।

বিলেতের বাইরের পাঠকদের জন্য
কারিকুরি সম্পর্কে ব্যাখ্যা
এই কারি সম্পর্কেও একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। অনেকেই আমাদের কাছে কারি শব্দের মানে বুজতে চান। কারি একটা তামিল শব্দ। বৃটেনে কারি বলতে ভারতীয় উপমহাদেশীয় খাবার দাবার বুঝায়। আবার ভারতেও আমাদের এই ম্বকারিম্ব বলা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেক ভারতীয় শেফ এবং রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা আমাদের অথা‍র্ত্‌ ব্রিটিশরা এই কারি বলাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু বেশির ভাগ উপমহাদেশীয় রেষ্টুরেন্টগুলো এখানে কারি হাউস বলে পরিচিত।
এটাকে যদি অন্য ভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন ধরুন একজন ব্রিটিশ ভোজন রসিক তার বাড়িতে টেকওয়ে খাবার অর্ডার দেবে, সে তখন বলতে পারে ‘আমি কারি অর্ডার করছি’ অথবা ‘আমি পিজা অর্ডার করছি।’ এখানে কারি অর্ডার করার মানে বুজতে হবে সে আসলে আমাদের উপমহাদেশীয় খাবার অর্ডার করছে। কারি হিসাবে যার পরিচিতি সেটা বলতে আপত্তি কোথায়?
এখানে আরেকটু বলে রাখি। ব্রিটেনের বামিংহ্যাম এলাকায় বালটি বলে ভারত উপমহাদেশীয় একটি জনপ্রিয় খাবার আছে। অথচ আমাদের বালটিশব্দ শুনলে খটকা লাগতে পারে। কারণ আমরা বালটিকে একটি পাত্র বা বাকেট হিসাবে জানি। আমার এখানকার পাঠকদের জন্য কারি, বালটি এসব বিষয়ের কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাইরের পাঠকের জন্য এটার সামান্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি।

ব্রিটিশ কারি ফেষ্টিভ্যাল
আমি বৃটিশ ষ্টাইলের কারি ফেষ্টিভ্যালের প্রথমে উদ্যোগ নেই ২০০২ সালে ঢাকা শেরাটন হোটেলে। এর নাম ছিল তখন বি্রটিশ বাংলাদেশী ফিউশন ফুড ফেষ্টিভ্যাল। পরবর্তিতে এটার নাম, আয়োজন এবং প্রকার ভেদের পরিবর্তন হয়েছে এবং সারা বিশ্বে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। এটা মূলত সম্ভব হয়েছে কারি লাইফ প্রকাশিত হবার পর একদল শেফ এর কঠোর পরিশ’্রমের ফলে। কারি লাইফ প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালের মার্চ মাসে।
প্রথম ফেষ্টিভ্যালে অংশ নেন চারজন অসাধারণ মেধাবী ব্রিটিশ বাংলাদেশী শেফ এবং তারা হচ্চেছন: আজাদ হোসেন, রইস আলী, মোহাম্মদ ইয়াহিয়া এবং ফকরুল ইসলাম দেওয়ান। এই দু:সাহসী উদ্যোগে মূল ভূমিকায় ছিলেন শেফ আজাদ হোসেন এবং তিনি এখনো এই পেশায় যুক্ত আছেন। দু:সাহসী এই কারণে বললাম যে বিলেত থেকে গিয়ে বাংলাদেশে ব্রিটিশ কারি প্রমোট করা তাও ফাইভ স্টার হোটেলে, যা ছিলো আমাদের কল্পনার বাইরে। সরকার মালিকানাধীন শেরাটন হোটেলকে এই ফেষ্টিভ্যালের স্বাগতিক হোটেল হিসাবে রাজি করাতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো।
কিন্তু ভাগ্যক্রমে শেরাটনে কর্মরত সিলেটের এক কৃতী সন্তান যিনি বিলেতের কারি ব্যবসা সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তার সহযোগিতায় এটা সম্ভব হয়েছিলো। আর ব্রিটিশ হাই কমিশনের ব্যাপক সহযোগিতায় আমরা সফল হয়েছিলাম সর্ব প্রথম ব্রিটিশ কারিকে দেশের বাইরে নিয়ে সফল ভাবে প্রমোট করতে। পরে এই হোটেলে লাগাতার প্রায় ৮/৯ বছর ব্যাপী আমরা এই ফেষ্টিভ্যালের আয়োজন করেছি। বাংলাদেশে এই প্রথম এ ধরণের ব্রিটিশ ফুড ফেস্টিভ্যাল ছিল সুপার হিট।
ব্রিটেনের এই কারি ব্যবসার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এর শুরু কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে। যেখান থেকে এই ব্যবসার শুরু সেখানে গিয়ে ব্রিটিশ স্টাইলের কারি বা খাবার পরিবেশন করা সত্যিকার ভাবে একটা চ্যালেঞ্জ। ব্রিটিশ মিডিয়ায় এটা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। অনেক মিডিয়া এটাকে তুলনা করেছে যে শহরে কয়লার খনি আছে সে শহরে বাইরে থেকে নিয়ে গিয়ে কয়লা বিক্রির বিরল ঘটনার সাথে।
ধীরে ধীরে এই ব্রিটিশ কারি প্রমোশনের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে, আরো অনেক কারি হাউসের প্রতিভাবান শেফদের দিয়ে, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফেষ্টিভ্যালের আমরা আয়োজন করেছি এবং এখনো ব্রিটিশ হাই কমিশন এবং দূতাবাসগুলোর সহযোগিতায় প্রতিবছর এই ফেষ্টিভ্যালের আয়োজন করি।
আমার সাথে এই ফেষ্টিভ্যাল আয়োজেনে আরো ছিলেন আমার আরেক বন্ধু যিনি ফুড সেইফটির পেশায় যুক্ত এবং তিনি হচ্চেছন শামসুল ইসলাম। শামসুল পুরোদমে ব্রিটিশ বাংলাদেশী যুবক, যার জন্ম এখানকার বাঙালী পরিবারে এবং বড় হয়েছেন এখানে। এই ২০২০ সালে এসেও এখনো তিনি এই ফেষ্টিভ্যালের কাজে যুক্ত আছেন। আমাদের পরবর্তি ফেষ্টিভ্যাল হবে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে, তার সফল আয়োজনে জন্য তিনি রাতদিন কাজ করে যাচ্চেছন।
এই ফেষ্টিভ্যাল আয়োজন করতে গিয়ে কারি লাইফ টীম এর আমরা সবাই বিশ্বের কত দেশ ঘুরতে পেরেছি এবং কত ধরনের খাবারের স্বাদ নেবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। হয়েছে নানা মজার মজার অভিজ্ঞতা। এসব নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্চছা আছে।
বিশ্বের এক সেরা পর্যটক যিনি বাংলাদেশেও গিয়েছেন এবং তার ভ্রমনের কথা আমরা ইতিহাসে পড়ি। তিনি হচ্ছেন ইবনে বতুতা। তার একটি বিখ্যাত উক্তি আছে যার স্বারমর্ম হলো, ‘ভ্রমনের মুগ্ধতা প্রথমে তোমাকে বাকরুদ্ধ করবে, কিন্তু পরবর্তিতে তোমাকে একজন গল্প কথক হিসাবে তৈরী করবে।’ আমারও সেই অবস্থা হয়েছে। ভ্রমন করতে করতে আমিও একজন গল্প কথক হয়ে গেছি।
আমরা জানি কারি শিল্পের যুবরাজদের মধ্যে শতভাগই বাংলাদেশের বাঙালী। তাদের সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে কলকাতার বিখ্যাত লেখক শংকর (পুরো নাম মনি শংকর মুখার্জী) একবার আমাকে বলেছেন, ‘ব্রিটিশরা আমাদের এই বাঙালীদের তৈরী খাবারের কাছে একেবারে আত্মসমর্পণ করেছে।’
খাবার দাবার নিয়ে তার লেখা এক বইয়েও তা তিনি উল্লেখ করেছেন। মূলত বাংলাদেশের বাঙালীদের বৃটেনে ‘কারি বিল্পব’ নিয়েই তার এই মন্তব্য।
শংকর নিজেও কিন্তু মূলতো পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) সন্তান। নিজেকে মনে প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি মনে করেন। কলকাতায় কারি লাইফের উদ্যোগে ব্রিটিশ কারি ফেষ্টিভ্যাল করতে গিয়ে তার সাথে আলাপ হয় এবং তিনি আমাদের কারি শেফদের তৈরী খাবারের স্বাদ নেন। তার এই মন্তব্য কিন্তু আমদের কারি শেফদের জন্য একটা খুব বড় প্রাপ্তি। যার গল্পের উপর ভিত্তি করে আরেক বাঘা বাঙালী অস্কার বিজয়ী চলচ্চিচত্র নির্মাতা সত্যজিত রায় ছবি তৈরী করেছেন। বাঙালী কারি শেফদের নিয়ে তার শংকরের এই মন্তব্য মোটেই ছোট করে দেখার বিষয় নয়।

আমাদের ভালো মন্দ
আমাদের এই নতুন কারি শেফ ম্যাগাজিনে যা লিখবো, তা কারি লাইফে মন চাইলেও লিখতে পারবোনা। এর ব্যাখ্যা আমি আগেই দিয়ে রাখতে চাই। কারি লাইফ ম্যাগাজিনের অনেক অবাঙালী পাঠক আছেন। আমাদের কারি ব্যবসা নিয়ে ভালো মন্দ বা আত্মসমালেচনা করতে হয়, তা আমি অন্যদের সামনে কেন করবো? আমাদের ভালো মন্দ হলো, আমাদের নিজস্ব ব্যাপার।
হিসাব করলে দেখা যায় আমাদের বেশীর ভাগ শেফরা মূলত কাজ শিখেছেন অন্যের সাথে কাজ করতে গিয়ে ‘অন দ্যা জব কুকিং’ রপ্ত করেছেন। তারা যদি ভারত বা অন্যান্য দেশ থেকে আগত শেফদের মতো কালিনারী কলেজ পাশ করে এবং বড় বড় হোটেল রেষ্টুরেন্টে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে এখানে রেষ্টুরেন্টের হাল ধরতেন, এ ব্যবসায় বৈল্পবিক পরিবর্তন আসতো।
ভারত থেকে এই ব্যবসায় আজকাল যারা এসে হাল ধরেছেন, তাদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। ভারতের আনাচে কানাচে, ছোট ছোট শহরে নামিদামী হোটেল, রেষ্টুরেন্ট এবং কালিনারী স্কুল কলেজ রয়েছে, যা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে।
তবে মজার ব্যাপার হলো, আমাদের বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টগুলো ও শেফদের সাথে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় ভারতীয় বড় বড় রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ও নামিদামী শেফরা হার মানতে বাধ্য হচ্চেছন। মূল কারণ হলো কারি পিপাসু ব্রিটিশ ক্রেতাদের কাছে এখনো বাংলাদেশী শেফদের তৈরী খাবারই বেশী জনপ্রিয়। তাদের তৈরী খাবারে যে ইউনিক বা অনন্য স্বাদ থাকে, এটা কোন ভারতীয় শেফ তৈরী করতে পারেন না।
তাছাড়া আমাদের শেফরা বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক খাবারের উপাদান যেভাবে তাদের মেন্যুতে উপস্থাপন করেছেন এটাকে ভারতীয় শেফরার কোনভাবেই খন্ডন করতে পারেননা। যেমন ধরুন, ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল এসব এলাকার খাবার ও উপাদান কোন ভাবেই ভারতীয় শেফদের কাছে পরাজিত হবেনা এবং হতে পারেনা। তাই বাংলাদেশ ঘুরে আসা বিখ্যাত ব্রিটিশ টিভি শেফ রিক স্টাইনকে দেখা যায় তার লোকাল রেষ্টুরেন্ট অথা‍র্ত কারি হাউসে গিয়ে গরুর মাংস দিয়ে সাতকরা অর্ডার দিতে। এটা সিলেট এলাকার একটি জনপ্রিয় খাবার।
বড় বড় শহর যেমন লন্ডন, ম্যানচেষ্টার, নিউক্যাসেল ইত্যাদি জায়গায় কিংবা শহরতলিতে যেসব ভারতীয় নব্য রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা বিশাল অর্থের বিনিময়ে বড় বড় রেষ্টুরেন্ট করেছেন, অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে বাড়ি চলে গেছেন বা অন্য ব্যবসা ধরেছেন। এমন কি মিশেলিন স্টার প্রাপ্ত শেফদের হাবুডুবু খেতে হচ্ছে।
কারণ কাষ্টমার রেষ্টরেন্টে পা রেখেই চাইবে তার টিক্কা মশলা, মাদ্রাজ, ডানসাক, ভিন্দালু, দোপিয়াজা, কোরমা, বোম্বাই পটেটো ইত্যাদি। এখানে হায়দরাবাদি বিরিয়ানী, ডাল মাখনী, বাটার চিকেন হার মেনেছে। তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে যে খাবার খেয়ে অব্যস্ত তা বদল করা খুবই কঠিন। একজন ব্রিটিশ ক্রেতার কাছে তার বাংলাদেশী শেফের তৈরী কোরমা অনেক মজাদার সেখানে কাশ্মির বা লকনোর কোরমা চলবেনা।
আমার এক ব্রিটিশ জার্নালিষ্ট বন্ধূ ডেভিড ডউকীন ডেইলী মেইল ছেড়ে সম্প্রতি আরেকটি অত্যন্ত বিত্তশালী ম্যাগাজিন গ্রুপের জন্য খাবার নিয়ে লেখালেখি করেন। আমাকে কয়েক মাস আগে হঠাত একদিন ফোন করে বললো, তোমাকে নিয়ে নতুন রেষ্টুরেন্ট লন্ডনের ইন্ডিয়ান একসেন্টে যেতে চাই। আমি পিআর কোম্পানীর ইনভাইট অতীতে প্রত্যাখ্যান করেছি। নিউ ইয়র্কের মিশেলিন স্টার ভারতীয় শেফ মনিশ মালহোত্রার প্রতিষ্ঠিত এই রেষ্টুরেন্টের দিল্লী শাখায় খাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু সেখানে সীট পেতে হলে অনেক লবি করতে হয়। যাই হোক আমার বন্ধুকে হতাশ না করে আমি রাজি হই তার সঙ্গী হতে।
আমার বন্ধুর ইন্ডিয়ান একসেন্টের খাবার ও গিমিক (চমক) তেমন পছন্দ হয়নি। আমারও তেমন ভালো লাগেনি, আমি ডেভিডকে সেটা বুঝতে না দিলেও সে বুজতে পেরেছ। খাবার খেয়ে বেরোবার পর ডেভিড আমাকে বললো ‘তুমিতো বুঝো পেশার কারণে আমাকে অনেক জায়গায় খেতে হয় কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি এখানে তোমাকে এনে আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। সবুর কর, আমি পুশিয়ে দেবো আমার প্রিয় রেষ্টুরেন্ট তৈয়বে তোমাকে আমি পরের বার নিয়ে যাবো।’
পূর্ব লন্ডনের তৈয়বে যদিও আমার নিয়মিত যাতায়াত আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং ডেভিডকে বললাম, বেশী দিন নেই এই রেষ্টুরেন্ট লন্ডন ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। তাই হয়েছে। সাম্প্রতিক খবর হলো ইন্ডিয়ান একসেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে।

হক কথা তেতো হয়
এবার দু’একটা অপ্রিয় সত্য কথা বলে এই পর্বে বিদায় নিচ্ছি। অপ্রিয় এই কারণে বলছি, সাধারণত ‘হক কথা তেতো হয়।’ এই কথাটি বলেছিলেন বাংলাদেশের পরম শ্রদ্ধাভাজন রাজনৈতিক নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকলেও মওলানা সাহেব আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি শেখ সাহেবকে এরকম কিছু হক কথা বলে নসিহত করেছিলেন। এসব তিনি শুনলে এবং গুরুত্বের সাথে নিলে হয়তো আমাদের বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনকের তার নিজ দলের বিশ্বাসঘাতকদের হতে এই নির্মম পরিণতি হতোনা।
যা হোক আমি নগন্য মানুষের হক কথাটি হলো, আমরা বাংলাদেশীরা হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করে বিশাল রেষ্টুরেন্ট খুলি কিন্তু স্টাফ ট্রেনিং, মার্কেটিং এর জন্য কোন বাজেট রাখিনা। যে কিচেন হলো সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অংশ রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার, সেখানে আমরা পুরাতন কুকার এবং বর্তমান যুগের উপযোগি নয় এমন সব জিনিসপত্র ব্যবহার করি। টেকনোলোজির ব্যবহার যেমন ইপস, কিচেনের জন্য আধুনিক কম্বি ওভেন ইত্যাদি বর্তমান যুগের টেকনোলজির কথা আমরা একদম ভুলে যাই। তারচেয়েও খারাপ যেটা আমাদের স্টাফদের আমরা ভালো কাজের ইউনিফর্ম পর্যন্ত দেইনা। প্রায় রেষ্টুরেন্টের শেফদের যখন আমরা লম্বা বুচার বা কসাইখানার জ্যাকেট পড়ে কাজ করতে দেখি এই দৈন্যতা দেখে খারাপ লাগে। শেফদের বাধ্যতামুলকভাবে ট্রেনিংয়ে না দিয়ে জাল সার্টিফিকেট বা পয়সা দিয়ে সার্টিফিকেট কেনার খোঁজে থাকি। এই কিছুদিন আগেও একজন রেষ্টুরেন্ট মালিকের এসব কারণে সাজা হয়েছে।
আবার ভালো লাগে যখন দেখি একজন শেফ কোন এওয়ার্ডে প্রাপ্ত ব্রান্ডেড শেফ জ্যাকেটটি যত্নের সাথে বিশেষ দিনে মাঝে মাঝে পরিধান করেন। এই ভাইরাস উপেক্ষা করে অনেক শেফদের দেখেছি কারি লাইফ এয়ার্ডে প্রাপ্ত শেফ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে হাসপাতালে এনএইচএস ষ্টাফদের ফুড ডেলিভারী দিচ্চেছন। তাদের এই পেশাধারী সাজ প্রশংসার দাবী রাখে এবং তাদেরকে আমি অভিনন্দন জানাই।
আমি এমনও দেখেছি একযুগ আগে কারি লাইফ থেকে দেয়া ব্রান্ডেড শেফ জ্যাকেট অনেক শেফ এখনো যত্নের সাথে রেখে দিয়েছেন। অলিম্পিকে প্রাপ্ত স্বর্ণপদকের মতো বিশেষ দিনে এটা গর্ব করে যখন পরিধান করে তারা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন, দেখে আমার খুব ভালো লাগে।

আমাদের অস্তিত্বের জন্য এখন প্রয়োজন বৈপ্লবিক পরিবর্তন
এই ব্যবসায় বাংলাদেশের বাঙালীদের বিশাল সাফল্য থাকলেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন না আনলে এবং এই ব্যবসায়, খাবার মান, কাষ্টমার সেবা. কিচেন এবং ফ্রন্ট হাউস ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে আমাদেরও এই ব্যবসা ছেড়ে পালাতে হবে। এটা দু:খজনক হলেও সত্য। যত দ্রুত আমাদের এই উপলব্দি হবে ততই মঙ্গল।

Share it in social media


আরও খবর