কারি শিল্পের যুবরাজদের কাহিনী (পর্ব -2)

-- সৈয়দ বেলাল আহমেদ  
 

ব্রিটিশদের আবার খাবার কি

এনিয়ে দেশে বিদেশে অবহেলাসূচক একটা জনশ্রুতি আছে। বিশেষ করে কন্টিনেন্টাল ইউরোপে এমনকি আমাদের উপমহাদেশেও। কারি লাইফ ম্যাগাজিনের সহায়তায় এই জনশ্রুতি বদলে দিয়েছেন ব্রিটিশ বাঙালি রন্ধন শিল্পীরা । বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ‘ব্রিটিশ কারি’ বিক্রি করে সেসব দেশের ভোজন রসিকদের ধারণা পাল্টে দিয়েছেন আমাদের এই কারি শিল্পের যুবরাজরা। আর এতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট দেশে নিযুক্ত আমাদের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতরা। এসব যুবরাজ ও রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের এই পর্ব লিখেছেন কারি শেফ ম্যাগাজিনের সম্পাদক সৈয়দ বেলাল আহমেদ।

কারি শিল্পের যুবরাজদের নিয়ে লিখতে হলে এই ব্যবসার সবদিক নিয়ে লিখতে হয়। যদিও কারি শেফ ম্যাগাজিনটি মূলত শেফদের ভালো মন্দ নানা দিক তুলে ধরবে, কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার একটা প্রধান বিষয় হলো সার্ভিস যার দায়িত্বে মূলত থাকেন আমাদের ওয়েটার ভাইবোনরা।
এটা খুবই আশার কথা যে রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার সবদিকে এখন যুক্ত হচ্ছেন আমাদের বোনরা। সেটা কিচেনে শেফ বা সামনে ম্যানেজমেন্ট এবং কখনো কখনো সার্ভিসের পুরো দায়িত্ব তারা নিতে এগিয়ে আসছেন। এটা আগেও ছিলো, কিন্তু সংখ্যায় খুবই নগণ্য। এখন তাদের এই দায়িত্ব গ্রহণ নজর কারার মতো।
আমি আগের পর্বে লিখেছি শেফদের পেশা কত সম্মানের এবং কেন এই পেশায় আমাদের নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু একজন ওয়েটারের পেশা কম সম্মানের নয়। কারি হাউসে ওয়েটার ভাইদের নিয়ে গৌরবগাঁথা নিয়ে বিস্তর লেখা যায়।
আগের পর্বে যেমন লিখেছি আমাদের বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টের শেফ ভাইরা মূলত একে অন্যের দেখাদেখি কাজ শিখেছেন। অর্থাৎ তাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা এসেছে অন দ্য জব ট্রেনিং এর মাধ্যমে।
কারি হাউসের ওয়েটার ভাইদের বেলাও কিন্তু একই রকম প্রশিক্ষণ হয়েছে। অনেকের এটাই ছিলো হয়তো জীবনের প্রথম চাকুরি এবং অনেকে সদ্য বাংলাদেশ থেকে ইংরেজী ভাষা রপ্ত না থাকলেও শেখার হাতেখড়ি হয়েছে এই ওয়েটারির কাজের মাধ্যমে। এমনও আছে কেউ হয়তো পড়াশুনার জন্য বিলেতে এসেছেন। পড়াশুনার ফাঁকে খন্ডকালিন রেষ্টুরেন্টে ওয়েটারির কাজের সুযোগ নিয়েছেন। এটা রেষ্টুরেন্টগুলোর জন্য বেশ কাজে লেগেছে।
কিন্তু ওয়েটারী পেশার ক্ষেত্রেও হসপিটালিটি কলেজ থেকে ডিগ্রী নিয়ে বা পূর্ব প্রশিক্ষণ নিয়ে খুব কম লোক কারি হাউসে যোগ দিয়েছেন। তারা মোটামুটি অন দ্য জব ট্্েরনিং নিয়েছেন বা এখনো নিচ্ছেন।
অনেকে এই পেশায় খুব ভালো করছেন এবং দ্রুত কাজ রপ্ত করেছেন। নিজে ব্যবসা করে অনেকে আবার এই পেশায় অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন।
মজার ব্যাপার হলো ওয়েটারী পেশার প্রতি নতুন প্রজন্মের বাঙালীদের অনেকটা অনিহা দেখে খুবই দু:খ হয়। অথচ এই পেশা খুবই সম্মানজনক। অনেক বড় বড় লোক যারা নানা দিক দিয়ে সফলতার উচুতে পৌছে গেছেন তাদের কিন্তু বাংলাদেশী কারি হাউসে ওয়েটারির অভিজ্ঞতা আছে।
অনেকে হয়তো জানেননা। পকিস্তানের জাঁদরেল নেতা জুলফিকার আলী ভূট্রো লন্ডনের একটি বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করেছেন। এই রেষ্টুরেন্ট এখনো বাংলাদেশীদের হাতে আছে। ভুট্টো তখন অবশ্য লন্ডনে পড়াশোনা করছিলেন। এরকম অনেকের কথা বলতে পারি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে ঢাকায় ব্রিটিশ কারি ফেষ্টিভ্যাল করতে গিয়ে একটি স্মৃতি। আমাদের সবার পরিচিতজন তৎকালিন ঢাকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার জনাব আনোয়ার চৌধুরী ছিলেন আমাদের ফেষ্টিভ্যালের প্রধান অতিথি। তিনি তার বক্তব্যে অত্যন্ত গর্বের সাথে ছাত্র থাকা কালে কারি হাউসে ওয়েটারী করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
আনোয়ার চৌধুরীর আন্তরিকতার স্পর্শ আমাদের ফেষ্টিভ্যালে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ডেলিগেট পেয়েছেন। তিনি সবাইকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সবাইকে এই ব্যবসা ও পেশা আরো এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
আসলে বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের সাথে কাজের সূত্রে যারা অন্য পেশা থেকে এসে সম্পৃক্ত হয়েছেন, পরবর্তি জীবনে লক্ষ্য করেছি এই পেশা ও ব্যবসাকে তারা খুবই শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার চোখে দেখেন। এটা কারি ব্যবসায়ীদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি।
ব্রিটিশ কারি ফেষ্টিভ্যাল করতে গিয়ে ভারতে অবস্থিত একটি বিশাল হোটেল গ্রুপ হায়াত রিজেন্সি হোটেলের আমন্ত্রণে ২০১৫ সালে আমি পৌছাই দক্ষিন ভারতের সমুদ্র বন্দর শহর চেন্নাইতে। বঙ্গপোসাগরের অপর প্রান্তে অবস্থিত চেন্নাই নগরী আমাদের কাছে অনেক আগে থেকেই সুপরিচিত ছিলো মাদ্রাজ (মূল নাম) হিসাবে। এই বন্দর নগরীর সাথে রয়েছে বৃটেনের দীর্ঘদিনের ইতিহাস জড়িত। শুধু তাই নয়, আমাদের বাংলাদেশেরও রয়েছে একটা বড় যোগসূত্র। তাহলো অবশ্যই ইতিহাস ঐতিহ্য ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের যোগসূত্র। একই সমুদ্রের এপার ওপার।
আমাদের ব্রিটিশ কারি ফেষ্টিভ্যালের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী প্রতিটি অনুষ্ঠান আমরা আয়োজন করি ব্রিটিশ হাই কমিশন বা দূতাবাসের সহযোগিতায়। চেন্নাইতে পৌছার আগেই আমি স্থানীয় ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনে ইমেইলে এই ফেষ্টিভ্যালের আদর্শ ও উদ্দেশ্য বর্ননা করে সহযোগিতা চেয়ে বার্তা পাঠাই। পৌছে আবার এই মর্মে যোগাযোগ করি এবং আমার অবস্থান জানাই।

কিছুক্ষণ পরেই ডেপুটি হাই কমিশনার সরাসরি ফোন করে কুশলাদি আলাপ করে আমাকে বলেন, আপনাকে কষ্ট করে হাই কমিশনে আসতে হবেনা, আমি নিজেই আপনার হোটেলে পৌছে যাবো।
তিনি কথামতো তার দলবল (কর্মকর্তাদের) নিয়ে ঠিকই আমার সাথে সাক্ষাতে হায়াত রিজেন্সি হোটেলে পৌছান। এই খানে একটা মজার কান্ড ঘটেছে।
বিটেনে চেন্নাইতে নিযুক্ত এই ডেপুটি হাই কমিশনারের নাম ভারত যোশী। তিনি চেন্নাইতে নিযুক্তির আগে ক্যামারুনে ব্রিটিশ হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে কয়েক বছর ঢাকায় ব্রিটিশ হাই কমিশনেও কাজ করেছেন।
যাহোক ভারত যোশীকে স্বাগত জানাতে আমি হোটেল লবিতে নামার সাথে সাথে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পাশা কোথায়?
আমি চেন্নাই পৌছার আগে যে ইমেইল করেছিলাম, সেখানে উল্লেখ করেছিলাম যে, এই ফেষ্টিভ্যালের আযোজনের প্রস্তুতি কাজের জন্য আমি ও আমার ভাই পাশা (সৈয়দ নাহাস পাশা) এক সাথে আসতে পারি। পরে পাশা ভাই যেতে পারননি এবং আমি একাই সেখানে পৌছাই। কিন্তু এখানে এই পাশা নামের একটা বিড়ম্বনা আছে যা আমাকে অনেকদিন ধরে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এ নিয়ে পরবর্তিতে আরো আলাপ করবো।
বিলেতে আবার আমাদের কারি ব্যবসার আইকন আরেক পাশা বিরাজমান। উনি হলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ক্যাটারার্স এসোসিয়েশনের নেতৃত্বের সাথে জড়িত পাশা খন্দকার এমবিই। অনেকে পাশা নামের সূত্রে আমাকে তার ছোটভাই মনে করেন (যদিও আমার নামের সাথে পাশা যুক্ত নয়, সেটার ব্যাখা আরেকদিন দেবো)। আমিও এক সাথে নাহাস পাশা ও পাশা খন্দকারের ছোট ভাই হিসাবে গর্বিত।
ডেপুটি হাই কমিশনার ভারত যোশী আবার আমাদের পাশা খন্দকারের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ এবং তাদের রয়েছে পারিবারিক সম্পর্ক। এ কথা আগে আমার জানা ছিলোনা। ভারত মনে করেছেন যেহেতু এটা কারি ব্যবসার ফেষ্টিভ্যাল নিশ্চয়ই পাশা খন্দকার আমার সাথে রয়েছেন এবং আমি তো আগেই বলেছি আমার সাথে পাশা থাকবেন। পরে আমরা এই নিয়ে অনেক হাসি ঠাট্টা করলাম। আমিও এই পাশা নাম নিয়ে আমার সারা জীবনের বিড়ম্বনার কথা তার সাথে শেয়ার করলাম।
আমার প্রস্তাবিত ব্রিটিশ কারি ফেষ্টিভ্যালের ব্যাপারে ভারত যোশী আমাকে সব ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি আমার ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু সম্ভব এই ব্রিটিশ কারি ফেষ্টিভ্যাল সফল করতে সহযোগিতা করবো। আরো বললেন, আমি ভালো করে জানি এই ব্যবসার সাথে ব্রিটেনে মূলত বাংলাদেশীরা জড়িত এবং ব্রিটিশ কারি ব্যবসাকে বাংলাদেশীরা খুবই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আমার পড়াশুনা হলো ডিপ্লোমেসী নিয়ে নয়, তা হলো হসপিটালিটি নিয়ে। শুধু তাই নয় আমি পড়াশুনার সময় বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে ওয়েটার হিসাবে কাজ করেছি। এই রেষ্টুরেন্ট হলো কেন্টের ওয়েষ্টমলিং – এর গান্ধী রেষ্টুরেন্ট এবং পাশা খন্দকার আমার বন্ধু। তিনি আমাকে কাজের সুযোগ দেন।
আমিতো শুধু অবাক নই একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ। মন্ত্রমুগ্ধ এই কারণে ভারতের মাটিতে বসে আমি শুনছি আমাদের কারি ব্যবসার গুণগান এবং সাফল্যের কথা। তাছাড়া ডেপুটি হাই কমিশনারের মতো একজন মানুষ আমাকে বলে যাচ্ছেন তিনি বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে ওয়েটারির কাজ করে তিনি গর্বিত। শুধু তাই নয়, তিনি সেই রেষ্টুরেন্টের শেফসহ যাদের সাথে কাজ করেছেন সবার নাম বলতে থাকলেন, যাদের আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনিনা। তবে বুজতে পারলাম তিনি সত্যি আন্তরিক, কথাগুলো বানিয়ে বলছেননা।
পরবর্তিতে আমরা কারি লাইফের পক্ষ থেকে অত্যন্ত সফল ভাবে কারি শিল্পের যুবরাজদের নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের বিখ্যাত বন্দর নগরী মাদ্রাজ (চেন্নাই) শহরে গিয়ে আমাদের রেষ্টুরেন্টগুলোর জনপ্রিয় ব্রিটিশ কারি ‘মাদ্রাজ’ পরিবেশন করতে সক্ষম হই। ’ডেলিভারীং মাদ্রাজ ফ্রম ব্রিটেন টু মাদ্রাজ’ এই সুযোগ কজনের হয়েছে?
চেন্নাই নগরীতে এই ফেষ্টিভ্যালের আয়োজন করতে গিয়ে আমার পরিচয় হয়, বিখ্যাত বাঙালী শেফ সুব্রত দেবনাথের সাথে। তিনি তখন হায়াত রিজেন্সী চেন্নাই হোটেলের এক্সেকিউটিভ শেফ। আমি যখন তার কাছে এই ফেষ্টিভ্যালের প্রস্তাব পাঠাই, তিনি সাদরে তা গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন হোটেলের বিভিন্ন কাজের সুবাদে সুব্রত শুধু কলকাতা নয়, হোটেল ব্যবসার একজন দক্ষ পরিচালক হিসাবে তার সুনাম রয়েছে ভারতের বিভিন্ন শহরে। আমরা ভাগ্যবান যে তার সাথে আমাদের দু’তিনবার কাজের সুযোগ হয়েছে।

Share it in social media


আরও খবর