গর্বিত শেফ হারুন মিয়া এ্যান্ড ব্রাদার্স

 

চিকেন টিক্কা মাসালা না কোরমা, জালফ্রেজি না ভিন্দালু। না।
চিকেন টিক্কা মাসালা ও জালফ্রেজিই সবচেয়ে পপুলার ডিস মনে করেন শেফ হারুন মিয়া। ৩২ বছর রেষ্টুরেন্টে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শেফ হারুন মিয়া অনেক রেষ্টুরেন্টে কাজ করেছেন, কিচেন পোর্টার থেকে কাজ করে শেফ হয়েছেন, প্রথম দিকে যে জবকে অপছন্দ করেছেন সে পেশাই এখন তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শুধু শেফই নয় একজন সফল ব্যবসায়ীও। ভাইদেরকে নিয়ে একটি জনপ্রিয় রেষ্টুরেন্ট পরিচালনা করছেন। ৩ভাই পরিচালিত পারিবারিক ব্যবসা লী ক্রস তান্দুরী শ্রপশায়ারের শ্রুসবারী টাউনে। কথা বলেন, তার জীবনের নানা দিক নিয়ে কারি শেফ প্রতিবেদকের সাথে।
মাত্র আঠারো বছর বয়সে যুক্তরাজ্যে আসেন হারুন মিয়া। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন চাকরির খোঁজে রয়েছেন তিনি। ১৯৮৮ সালে বার্মিংহ্যামে তখন রেষ্টুরেন্টে কাজের সুযোগ রয়েছে অনেক। কিন্তু সবচেয়ে নেতিবাচক দিকটি হলো সেখানে প্রত্যেকটি রেষ্টুরেন্ট লেট নাইট খোলা। রাত ৩টা চারটা পর্যন্ত রেষ্টুরেন্টে কাস্টমাররা আসতো। কাজ শেষ হতে হতে সকাল। বিশেষ করে সামার টাইমে এক দিন কাজ শুরু আর পরের দিন এর সমাপ্তি। অবশ্য তখনকার দিনে শুধু বার্মিংহ্যামই নয় যুক্তরাজ্যের অনেক বড় নগরিরই রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার হাল হকিকত ছিল এ রকমের। রেষ্টুরেন্টগুলো অন্ততপক্ষে রাত তিনটা পর্যন্ত খোলা থাকতো। রাত দুটো পর্যন্ত নাইট ক্লাব খোলা থাকতো। আর সেই নাইট ক্লাবের কাস্টমারদের ধরার জন্যেই কারি হাউসগুলো বসে থাকতো। যাই হোক সেটা অন্য কথা। এই কারি ব্যবসাই এখন অনেকদুর এগিয়ে গেছে।
ধরুন না হারুন মিয়ার বর্তমান রেষ্টুরেন্ট এর কথা। শ্রুসবারী শহরের উপকন্ঠে লীক্রস এলাকায় লীক্রস তান্দুরী। সপ্তাহে একদিন বন্ধ। রাত নটার পরে সচরাচর কাস্টমার কম। বিশাল একটি পুরানো পাব ও কার পার্ক নিয়ে একক অবস্থানে একটি রেষ্টুরেন্ট। সুন্দর পরিপাটি এই রেষ্টুরেন্টের কাস্টমাররাও লোকাল। স্থানীয় ব্যবসা হিসাবে শুধু সাপোর্টই করেন না নিজেদের খুব আপন করে নিয়েছেন রেষ্টুরেন্টের সবাইকে। এই চিত্র এখন এখন সারাদেশের সব ছোট গ্রাম ও শহরে। প্রায় প্রত্যেকটি কারি হাউসই তাদের নিজস্ব ক্লায়েন্ট বেইস গড়ে তুলেছেন।
হারুন মিয়ার চাকরি জীবন শুরু হয় বিলেতে আসার মাত্র দুই সপ্তাহ পরে। তিনি লেইট নাইটের রেষ্টুরেন্টে কাজ করতে চাননি। তাই এক আত্মীয়ের যোগসাজশে প্রথম চাকরি শুরু করেন ইপসুইচের বোম্বে রেষ্টুরেন্টে। হারুন মিয়া বলেন, প্রথমে মোটেই ভাল লাগেনি রেষ্টুরেন্টের চাকুরি। বাংলাদেশের আরাম আয়েশের জীবন কাঠানো এক তরুণ বিলেতে এসে এমন কাজ করবো ভাবতেও পারিনি। মনে হয়েছে এই কাজ কিভাবে করবো। যখন দেখলাম অন্যেরা এই কাজ করছে তখন নিজের মনকে সান্তনা দিয়ে বললাম কেন পারবোনা আমি। এখন এসব নিয়ে আর মোটেই অনুতাপ নেই হারুণ মিয়ার। আরও দুই ভাই ফয়জুল হাসান ও আবুল হোসেনকে নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তার জীবনের প্রথম ব্যবসার নাম ‘জয় বাংলা রেষ্টুরেন্ট’। বছর দুয়েক কাজের পরেই বন্ধু কয়েকজন মিলে রেষ্টুরেন্ট খুলেন হার্টফোর্ডশায়ারের ব্রক্সবোর্ণ এলাকায়। সেই জয় বাংলার জয়গানই তার জীবনে কারি ইন্ডাষ্ট্রিকে গেঁেথ দিয়েছে।
হারুন মিয়া যুক্তরাজ্যের আরও অনেক শহরে কাজ করেছেন। বিভিন্ন শেফের সাথে কাজের সূত্রে ভাল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কি বলায় হারুণ মিয়া বলেন, একজন শেফ এর জীবনে আর কি হতে পারে। কোন বিখ্যাত সিলেব্রিটি অথবা একজন সাধারণ কাস্টমার যখন শেফের খাবার খেয়ে তৃপ্ত হয়ে প্রশংসা করে সেটাই তার জীবনের বড় পাওয়া। হারুন মিয়া বলেন, হডেসডন এলাকার রাজগেইট রেষ্টুরেন্টে কাজ করতেন ৯০ এর দশকে। তখন সেখানে তান্দুরী শেফ হিসাবে ভালই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সেই রেষ্টুরেন্টে বিখ্যাত কাস্টমার ছিলেন পল গ্যাসকয়েন অর্থাৎ নামকরা ফুটবলার গাজা। গাজাকে খাবার তৈরি করে দেয়া তার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। শুধু তাই নয় হারুন মিয়া বলেন, তিনি ডেভিড বেকহ্যাম ও ভিক্টোরিয়া বেকহ্যামকে তার তৈরি খাবার পরিবেশন করেছেন। হার্টফোর্ড শায়ারের রাজগেইট রেষ্টুরেন্টে ডেভিড ও ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম যখন খেতে যান তখন তিনি কিচেনে কাজ করতেন। ৯০ এর দশকের প্রথম দিকে ভিক্টোরিয়া তখন স্পাইসগার্লের একজন ছিলেন। তখন বেকহাম তার সাথেই সেখানে গেছেন।
হারুন মিয়ার এই কাহিনীর সাথে মিল রয়েছে যুক্তরাজ্যের অনেক কারি হাউসের শেফদেরই। এরাই ইন্ডাষ্ট্রিকে সফলতায় ও উচ্চতায় নিয়েছেন। আজকে আমরা শুনি লন্ডনের অনেক বড় বড় ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট এ নিয়ে হম্বিতম্বি করেন। কিন্তু এজন্যে আমাদের হাজার হাজার কারি হাউসের শেফদের অবদানই সবচেয়ে বেশি।
হারুন মিয়া বলেন, তিন ভাই মিলে ১৯৯৯ সালে লীক্রস এলাকায় অঞ্জলি নামে রেষ্টুরেন্ট করেন তারা। ব্যবসা মোটামুটি চলছিল। সেখানে শ্রুসবারী ফ্লাওয়ার শোতে আসা একদল কাস্টমার রেষ্টুরেন্টে খেতে যান। এদের মধ্যে ফুড ক্রিটিকও ছিলেন। পরবর্তীতে একটি ম্যাগাজিনে তাদের খাবারের প্রশংসা প্রকাশিত হলে ব্যবসা বাড়তে থাকে। সেই থেকে শুরু। গত বছর ভাল খাবারের জন্য কারি লাইফ এওয়ার্ডও পান শেফ হারুন মিয়া। হারুন মিয়া বলেন, অঞ্জলি রেষ্টুরেন্টের কয়েকশ’ গজ দুরে একটি পাব অকশনে বিক্রিতে আসলে তারা সেই পাবটি ক্রয় করে নতুন নামে রেষ্টুরেন্ট খোলেন। লী ক্রস তান্দুরীর যাত্রা শুরু হয় চার বছর আগে। একটি ব্যস্ত রেষ্টুরেন্ট এটি এখন সে এলাকার। হারুন মিয়া জানান, কাস্টমাররা সবাই ফ্রেন্ডলি স্থানীয় বাসিন্দা। পান্ডেমিকের কারণে প্রথম ৪/৫ সপ্তাহ রেষ্টুরেন্ট বন্ধ রাখেন এবং পরবর্তীতে শুধু মাত্র টেকওয়ের জন্য রেষ্টুরেন্ট খোলা রাখেন। তিনি জানান টেকওয়ে শুরুর পরে কাস্টমরার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন তাদের ফেভারিট খাবার পাওয়া যাচ্ছে। নতুন নিয়মে রেষ্টুরেন্ট খোলায় কতটুকু ব্যবসায় প্রভাব পড়বে বা ইডাষ্ট্রির নিউ নরমাল কতদিন বজায় থাকবে সেটাই তারা পর্যবেক্ষণ করছেন জানালেন শেফ হারুন মিয়া।

Share it in social media


আরও খবর