গুড়কীর্তন

 

শেখ সাইফুর রহমান

প্রতিটি ঋতুতেই প্রকৃতি তার নিটোল সৌন্দর্য্য নিয়ে উপস্থিত হয়। শীতও ব্যত্যয় ঘটায় না। বরং হাড়হিম শীত আমাদের স্মৃতিকাতর করে; ফিরিয়ে নেয় শৈশবের দিনগুলোতে। খেজুরের রস আর নলেন গুড়ের ম ম সৌরভ নাসারন্ধ্রে ফিরে ফিরে আসে। কারণ বাংলার শীতের সঙ্গে খেজুরের রস আর গুড় কোন সন্দেহ নেই সমার্থক। তবে তা কেবল খাদ্যসংস্কৃতির ঐতিহ্য আর কালিনারি ডেলিকেসিই নয় বরং এর সঙ্গে আরো অতপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে শারীরবৃত্তিয় সম্পর্কও; যেটা সম্পর্কে আমরা সম্যক অবগতও হয়ত নই। এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাচ্ছে।
তার আগে বলি গুড় শব্দটি শুনলেই আমার মাথায় আসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর চরিত্র মুচিরাম গুড়ের কথা। লেখকের ভাষায়: মুচিরাম গুড়় মহাশয় এই জগৎ পবিত্র করিবার জন্য, কোন্ শতকে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, ইতিহাস তাহা লেখে না। ইতিহাস এরূপ অনেকপ্রকার বদমাইশি করিয়া থাকে। এ দেশে ইতিহাসের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়না, নচেৎ উচিত ব্যবস্থা করা যাইত।
লেখকের এই ক্ষোভের কারণ অনেকেরই নিশ্চয় জানা। সে গল্পে না হয় না গেলাম। তবে জানিয়ে রাখা জরুরি, বঙ্কিমবাবুর মুচিরাম গুড় পড়ে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ‘মুচিরাম গুড়’ নামেই একটি কবিতা লেখেন। সেটা গ্রন্থিত হয় তাঁর ‘তুণীর’ কাব্যগ্রন্থে। ১৯২৮ সালে মুদ্রিত এই কাব্যগ্রন্থে ‘মুচিরাম গুড়’ কবিতার শুরুতে কবি লেখেন: ‘বঙ্কিম বাবুর মুচিরাম গুড়ের জীবনী পাঠান্তে লিখিত। বঙ্কিম বাবু নিজেই ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিন্তু মুচিরাম গুড়ের ন্যায় নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোকও তখন কেবলমাত্র তোষামুদীর বলে ঐ পদ পাইয়াছিল। এখনো মুচিরাম শ্রেণীর হাকিম দুষ্প্রাপ্য নহে।’
আপাতত মুচিরাম গুড় ছেড়ে আমরা খেজুরের গুড় প্রসঙ্গে ফিরি। সত্যি বলতে কি, প্রকৃতি আমাদের জন্য প্রায় সবকিছুই সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। আমরা জানিনা কিংবা খোঁজ রাখিনা বলেই কৃত্রিম উপাদানের উপরে নির্ভর করি। তবে নিজেদের অনিষ্ট সাধন করার কাজ অনেকটুকুই সেরে ফেলার পর মানুষ পুনরায় অনুধাবন করছে প্রকৃতি বিনে তার গতি নেই। তাই বর্তমানে আবিশ্বের মানুষ ক্রমেই প্রকৃতিমুখী হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর, বিষমুক্ত খাবারের প্রতি ঝুঁকছে। কারণ প্রকৃতিজাত খাদ্যে থাকে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের উপাদানের সুষম উপস্থিতি।

খেজুরের গুড়ের স্বাস্থ্যগুণ
এই যেমন খেজুরের গুড়ের কথাই ধরা যাক। শীতে কেন খেতে হবে এই মিষ্টি? কারণ গুড় উচ্চ ক্যালোরি যুক্ত। অথচ এই গুড়ই আবার অ্যান্টি-ফ্যাট। ফলে শরীরের জন্য শীতে এর প্রয়োজন অনেক বেশি। তবে উচ্চ ক্যালোরির কথা শুনে শরীর সচেতনদের চমকানোর কোন কারণ নেই। যেহেতু এর ক্যালোরির পরিমাণ চিনির চেয়ে কম। অতএব অনায়াসে চায়ে ব্যবহার করে দেখতে পারেন। এমন কি বানানো যেতে পারে নানা ধরণের ডেজার্টও। অবশ্য গুড় দিয়ে তৈরি আমাদের বাঙালির ডেজার্টের কি তুলনা হয়?
রসের পিঠা, হাতে তৈরি সেমাই, গুড় আর নারকেলের সঙ্গতে পুলি পিঠা, পায়েস, মোয়া আরো কতো কি। আহা! নাম নিলেই রসনা রীতিমত আর্দ্র হয়ে ওঠে। উত্তেজিত হয় স্বাদকোরক।
নলেন গুড়ের সন্দেশ আর রসগোল্লা তো হচ্ছে। তবে সে গুড় কতটা নলেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকে। এখন অবশ্য কেক আর আইসক্রিমও তৈরি হয় বঙ্গীয় উপাদানের আন্তর্জাতিকীকরণের প্রশংসনীয় প্রয়াস হিসাবে।
সে যাকগে, আমরা বরং আরো কিছুক্ষণ অব্যাহত রাখি গুড়কীর্তন। তারপর এই শিল্পকর্মের চৌহদ্দীতে টহল দেয়া যাবে।
বিভিন্ন অনু-পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি গুড়ে আছে আয়রন, ফসফরাস, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, কপার, জিঙ্ক, ভিটামিন বি ও সি।
গুড় শরীরে তাপমাত্রা উৎপাদন করে ও সেটা ধরে রাখতে সহায়তা করে। ফলে শীতের সময় শরীরের রক্ষাকবজ হিসাবে কাজ করে। ফলে কাছে ঘেঁষতে পারে না নানা রোগবালাই। ঠান্ডার প্রকোপ দূর করে। ভাল গুড় জ্বর-জারি, সর্দি-কাশি প্রতিরোধ করে। এতে থাকা মিনারেল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গুড় থেকে তৈরি উচ্চতাপমাত্রা ব্যাকটেরিয়ার ধংস করে সংক্রমণ রোধ করে। শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, পাকস্থলী, অন্ত্র ও ফুসফুসে অবাঞ্ছিত রোগের আক্রমণ প্রতিহত করে। এখানে শেষ নয়, বরং রক্তনালী প্রসারিত করে রক্তের প্রবাহ স্বাভাবিক করার পাশাপাশি হিমোগ্লোবিনের মাত্রাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখে।

ই-কর্মাসে গুড়
আগের দিনে গুড় হাটে বা বাজারে যেয়ে কিনতে হতো। সেই প্রথা একেবারে উঠে যায়নি। বরং বাঁশের ঝুঁড়িতে নতুন ওঠা ধানের বিচালি দিয়ে তার উপর অতীব যতেœ পাঠালি বা গুড়ের ভাঁড় সাজিয়ে নতুন গামছা দিয়ে ঢেকে বাঁশের ভারা বা বাঁকের দুপাশে রশি দিয়ে সুন্দর করে ঝুলিয়ে হাটে আনা হতো। সেই গুড় আস্তে আস্তে স্থান করে নিল সুপার শপে। আর প্রযুক্তির শনৈ শনৈ উন্নতিতে সেই গুড়ই মিলছে এখন অনলাইনে । বাসায় বসে অর্ডার করে কেনা যাচ্ছে। আছে নানা প্রতিষ্ঠান, নানা উদ্যোগ। চমৎকার বাক্সে, নজরকাড়া মোড়কে এই গুড় সরবারহ হচ্ছে। সুপার শপেও নানা ব্রান্ডের গুড় মিলবে আকর্ষক প্যাকেটে। ভালোর প্রতি মানুষের যে আবহমান কালের আগ্রহ সেটা আবারও প্রমাণ হচ্ছে। তবে এসব গুড়ের দাম তুলনামূলক বেশি হলেও ভালোটা তো মিলছে। সেটাই শান্তনার। অবশ্যই প্রান্তিক উৎপাদকরা কতোটা লাভবান হচ্ছে সেটাও দেখার বিষয়। তবে পশ্চিমবাংলায় খেজুরের গুড় টিউবে ভরে বিক্রির উদ্যোগ শুরু হয় ২০১৫। বিশ্ববাজার ধরার চেষ্টাতেই সেটা করা হয়। বাংলাদেশও এই ধরণের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারে।

ইতিহাসের পরতে গুড় থেকে বাদামী চিনি
এই অবকাশে একটু ইতিহাসের সরণি ঘুরে যেতে পারে। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ নামের সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থের কথা হয়ত অনেকেই জানা। এই গ্রন্থেই আছে নলেন গুড়ের বন্দনা আছে বলে উল্লেখ করেছেন ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায়, তাঁর গ্রন্থ বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব-এ।
খেজুরের গুড়ের জন্য দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর প্রসিদ্ধি বেশি। তবে উত্তরবঙ্গেও মেলে ভাল গুড়। অবশ্য এক সময় যশোরের গুড়েরর বিশেষ সুনাম ছিল। এখনও অবশ্য তিরোহিত হয়নি। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোর খুলনা ইতিহাস-এ, ‘১৯০০-১৯০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ। এর মধ্যে শুধু যশোরেই তৈরি হয়েছে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ গুড়। ১৮৬১ সালে মিস্টার নিউ হাউস চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের পারে তাহিরপুরে প্রথম খেজুরের গুড় উৎপাদনের যান্ত্রিক কারাখানা গড়ে তোলে। ওই কারখানার উৎপাদিত গুড় সেই সময়ে ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যশোরের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭টি কারখানা গড়ে ওঠে।
১৮৬১ সালে যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউস কারখানা স্থাপন করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্রাউন সুগার উৎপাদন করে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হন। তাহেরপুর স্থানটি মি. নিউ হাউসের পছন্দ হবার কারণ ছিল নৌপথে যাতায়াত সুবিধার জন্য। কপোতাক্ষ আর ভৈরবের সংযোগস্থল হওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণে সহজে যাতাযাত করা যেত। তখন কপোতাক্ষ নদ ছিল প্রমত্তা। ভৈরবও ছিল নাব্য নদ। তাহেরপুর চিনি কারখানা স্থাপনের পর সেখানে বড় বাজারও বসে। স্থাপিত হয় চিনি কারখানার ইংরেজ কর্মীদের আবাসস্থল। তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের ঘাটে এসে ভীড় করত দেশী বিদেশী জাহাজ। মূলত একটি বাণিজ্যিক নগর হিসাবে গড়ে ওঠে তাহেরপুর। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মি. নিউ হাউসের ব্রাউন সুগার কারখানাটি চলে। পরে তিনি কারখানাটি বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে যান। কারখানাটি ক্রয় করে ইংল্যান্ডের ‘এমেট এ্যান্ড চেম্বার্স কোম্পানি’। তারাও নানা কারণে ১৮৮৪ সালে বিক্রি করে দেন বালুচরের জমিদার রায় বাহাদুর ধনপতি সিংহের কাছে। ১৯০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর বংশধররা এটি চালাতে ব্যর্থ হন। এরপর ১৯০৯ সালে কাশিমবাজারের মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র, নাড়াজোলের রাজ্যবাহাদুর ও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সারদাচারণ মিত্রসহ কয়েকজন মিলে কারখানাটি ক্রয় করে নাম দেন ‘তাহেরপুর চিনি কারখানা’। নতুন ব্যবস্থাপনায় বৃটেন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয় কারখানাটিতে। ১৯১৫ সালের দিকে এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর আর কোনদিন কারখানাটি উৎপাদনের মুখ দেখেনি।
যশোরের খালিশপুর, মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, গঙ্গানন্দপুর, বোদখানা, ঝিকরগাছা, খাজুরা, রাজারহাট, রূপদিয়া, তালা, বসুন্দিয়া, ফুলতলা, কালীগঞ্জ, নোয়াপাড়া, নাভারণ, ইছাখাদা, কেশবপুর ও ত্রিমোহিনীসহ বিভিন্নস্থানে একরকম ঘরে ঘরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিনি কারখানা গড়ে ওঠে।
বর্তমানে খেজুরগাছের সংখ্যা যেমন কমছে তেমনি কমছে ক্লেশসাধ্য এই পেশায় টিকে থাকা পেশাজীবীদের সংখ্যাও। বিশেষত প্রজন্ম শিক্ষিত হওয়ায় পরিবারের এই পেশায় থাকায় অনীহায় অপূর্ব এক শিল্প ক্রমেই বিলুপ্তির পথে হাঁটছে।

হাজারি গুড় থেকে অর্গানিক গুড়
যাহোক, মানিকগঞ্জের ঝিটকার ইতিহাসপ্রসিদ্ধ হাজারি গুড়ের কথা আমরা অনেকেই জানি। বংশপরম্পরায় টিকে রয়েছে খেজুরের গুড় তৈরির অনবদ্য এই ক্র্যাফট। অবশ্য খেজুর গাছ কাটা থেকে রস সংগ্রহ মায়, গুড় তৈরি পুরোটাই একটা নিটোল শিল্পকর্ম। কেবর গাছ কাটার জন্য বর্তমানে একজনকে তিন মাসে ৭৬ হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে। আর এই গুড়ের দাম শুনে চোখ কপালে উঠতে পারে। ১৮০০ টাকা কেজি। তবে ভালো মানের গুড় বর্তমানে ৫০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে।
মধুবৃক্ষের মধুরস
শীত আসলে বাঙালির মন মধুতে মজবে না তা কি হয়। কিন্তু এ মধু সে মধু নয়। মৌমাছিরা তৈরি করে না। বরং এ মধু তৈরি হয় মধুবৃক্ষের রস থেকে। আহা এ রস আর তা থেকে তৈরি মধু অমৃতসমান। আসলে খেজুর গাছকে মধুবৃক্ষ বলা হয়।
গুড় দিয়ে রুটি খাওয়া প্রসঙ্গে সুকুমার রায়ের ‘ভালরে ভাল’ ছড়ার কথা মনে পড়ে গেল। অদ্ভূত সুন্দর এই ছড়াটির শেষ চারটে লাইন শেয়ার করলে মন্দ হয় না: শিমুল তুলো ধুনতে ভাল,/ ঠা-া জলে নাইতে ভাল,/ কিন্তু সবার চাইতে ভাল/ -পাউরুটি আর ঝোলা গুড় ।
পাউরুটি দিয়ে গুড় খাওয়া হালের প্রজন্ম জানেই না। আবার রুটি, বিশেষত, পরোটা দিয়ে ঝোলা গুড় আর পাটালির স্বাদও কিন্তু অনন্য। অবশ্য যে যাই বলুক, দুধ আর ভাতের সঙ্গে ঝোলা গুড়ই হোক বা পাটালির মিশ্রিত স্বাদ এক কথায় স্বর্গীয়।
মধুবৃক্ষের প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশে এক সময় সবচেয়ে বেশি খেজুরের গাছ ছিল যশোরে। কেবল সেখানেই নয়, কমেছে সর্বত্র। এর অন্যতম কারণ টেলিফোন টাওয়ার থেকে নির্গত ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গ।
অবাক করা বিষয় হলো, সবচেয়ে অযতেœ অবহেলায় বাড়ে খেজুর গাছ। একে লাগাতেও হয় না, পরিচর্যাও নয়। অথচ বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে চাষ করলে সুফল পাওয়া সম্ভব।

গাছঝোড়া ও রস সংগ্রহ
যাহোক, হেমন্তের শুরুতে হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করলে শুরু হয় খেজুরের গাছ কাটা। একে বলা হয় গাছ ঝোড়া। অথ্যাৎ এক বছরের মরা, আধামরা পাতা কেটে ময়লা ফেলে পরিপাটি করে তোলা। তারপর কয়েকদিন গ্যাপ দিয়ে গাছ চাঁছা হয়। এক বছর যেদিকে চাঁছা হয়, পরের বছর হয় ঠিক উল্টো দিকে। চাঁছার শেষ পর্যায়ে এসে নলি বসিয়ে রেখে আসা হয়। তারপর রস আসতে শুরু করলে ভালো করে আরো একবার চেঁছে নলির মুখে মাটির ভাঁড় বেঁধে দেয়া হয়। তার আগে ভাঁড় ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে খড়ের আগুনে সেঁকে স্টেরিলাইজড করে নেয়া হয়।
এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য আব্দুল জব্বারের ‘বাংলার চালচিত্র’। কি চমৎকার বর্ণনাই তিনি করেছেন: খেজুর গাছের পাতা ঝরানো হয়ে গেলে চাঁদি চেঁছে পাটিচাঁছ দিয়ে নলী পুঁতে দিয়ে আসতে হয়। তারপর প্রথম যেদিন চাঁছলে ঘাট গড়িয়ে নলী বেয়ে রস পড়ে ফোঁটা ফোঁটা করে, সেদিন ভাঁড় বাঁধেতে হয়। বুড়ী গাছে রস কম হয়, রসের রঙ হয় সোনালী। সেই রস হল বেশি স্বাদের আর বেশি মিষ্টি। কাঁচা রস খাওয়ার সাধ হলে চাষীরা সন্ধ্যার পর অথবা সকালে সেই রসই খায়। চারা গাছে অথবা খুব তেজী গাছের রস বেশি হয়। জলীয় অংশ তাতে বেশি থাকে। প্রথম দিনের যে রস হয় তাকে ‘নলেন’ রস বলে। পরের দিনের রসেন নাম ‘দো-কাটের রস’ বা ‘ঝারা’। তৃতীয় দিনে আর কাটা হবে না।
শীত যত বাড়ে সমান্তরালের বাড়ে রস। তৃতীয়দিনের রস হলো গিয়ে নিমঝরা। চতুর্থদিনের রস হলো ওলা। টানা চার দিন রস পাড়ার পর আবার অন্তত তিনদিন জিরেন (বিশ্রাম) দিতে হয়। এরপর আবার গাছা চাছাঁ হয়। ময়লা পরিষ্কার করা হয়। ময়লা পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয় খেজুরের বড় কাঁটা। তারপর ভাঁড় বাঁধা হয়। বিশ্রামের পর প্রথম রসকে বলে জিরেন-কাটের রস বলে।
আর এই শিল্পকর্ম যারা করেন তাঁরা স্থানভেদে গাছি বা শিউলি নামে পরিচিত। গাছ কাটতে যাওয়ার আগে তাদের প্রস্তুতিও দেখার মতো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারসাজিতে শীত পেছাচ্ছে। ফলে রসসংগ্রহের প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হচ্ছে। তবে এই রস সন্ধ্যায় বা সকালে খাওয়ার মজাই আলাদা। অথচ বতর্মানে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে এখন অনেকেই কাঁচা রস খেতে ভয় পান। ছেলেবেলায় আমাদের কাছে স্ট্র ছিল দূর্লভ। তাই পাটকাঠিকে ভাল করে পরিষ্কার করে রস খাওয়া হতো নিষ্পাপ আনন্দে।

নলেন বৃত্তান্ত
নতুন রস থেকে তৈরি গুড়ই আসলে নলেন গুড়। বস্তুত নলেন মানে নতুন। নলেন শব্দটি নাকি সংস্কৃত। আবার অন্যমত যে নেই তা নয়। বরং বলা হচ্ছে একটা দ্রাবিড়িয় শব্দ ‘ণরকু’ থেকে এসে থাকবে। কারণ এর অর্থ ছেদন করা। আবার ব্রজবুলি শব্দ ‘নওল’ বা নতুন থেকেও নলেন শব্দটির উদ্ভব বলে মনে করা হয়। এই নলেন গুড়ের আরো একটা নাম আছে। লালি গুড়।

চাইলেও মেলে না মাজু খাতুনেরা
যে কেউ জাল দিলে গুড় হয় বটে, তবে সে স্বাদ হয় না। গুড় পাকের জন্য সত্যিই হাত লাগে। পাকা হাত। কারণ রস জালের সঙ্গে ঘনত্বের ভারসাম্য রাখার প্রক্রিয়া (স্থানীয় ভাষায় বলে বীজ মারা) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিচ্ছেদের পরেও দুই হাঁড়ি খেজুর রস নিয়ে মোতালেফ মিয়াঁর ছোটা লাগে আগের বউ মাজু খাতুনের কাছে। কারণ নতুন বউ ফুলবানু সুন্দরী হলেও তার হাতে ঐ জাদু নেই। ফুলবানুর পাক দেয়া গুড় বাজারে বিকোয় না।
পাঠক হয়ত ভাবছেন মোতালেফ মিয়াঁ আর মাজু খাতুনেরা কোথা থেকে এলো। ঠিকই, খেজুর রস আর গুড় তৈরি নিয়ে অপূর্ব এক জীবননিষ্ঠ গল্প লিখেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। গল্পের নামও ‘রস’।
খেজুর গাছ কাটার বিদ্যা, রস পাড়ার বিদ্যা থেকে রস জাল দিয়ে গুড় তৈরির মুন্সীয়ানার সঙ্গে জীবনের উতর-চাপানের যে সম্পর্ক তা নিখুঁতভাবেই ক্যানভাসে ধরেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্প অবলম্বনে ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় হিন্দি ছবি সওদাগর; এতে মোতালেফ বা মোতি চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন আর মাজু চরিত্রে নূতন অভিনয় করেন।
বংশ পরম্পরার এক শিল্প খেজুরের গুড় তৈরি। অথচ মরুভূমির যেখানে বেসুমার খেজুর গাছ, সেখানকার মানুষের অসাধ্য এই শিল্প। সেসব দেশে ফলই মুখ্য। আর আমাদের এই তল্লাটে ফল নয়, মধুরসই আসল। বাঙালির জীবনে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে খেজুরের রস আর গুড়। উত্তর প্রজন্মকে এসব জানানোর কি প্রাণান্ত চেষ্টাই না করেন মুরুব্বিরা।
কারণ এ তো স্রেফ এক প্রক্রিয়া নয় বরং জীবনেরই নানা রূপ প্রতীয়মান হয়। এখানেও যে আছে ধৈর্য্য,যতœ, পারিপাট্য, পরিমিতিবোধ, সময়জ্ঞান, টানাপোড়েন আর নান্দনিকতা। স্পষ্ট হয়, ব্যক্তিজীবন যেমন, তেমনি পারিবারিক আর সমাজজীবনও।
এই প্রক্রিয়ায় পুরো পরিবার সম্পৃক্ত থাকলেও, অন্নসংস্থান হয় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক পেশার মানুষের।

লেখক: প্রথম আলোর উপসম্পাদক

Share it in social media


আরও খবর