মেজবানি মাংসের মাহাত্ম্য!

 

সামীউর রহমান

সুখাদ্যের সন্ধানে গোটা দুনিয়ার অনেকটাই চষে বেড়ানো সৈয়দ মুজতবা আলী নিজদেশে মাংস খেয়ে সুখ পাননি। রাখঢাক না করে “রন্ধন-যজ্ঞ” প্রবন্ধে লিখেই ফেলেছেন, “বাঙ্গালী বাড়িতে মাংস খেতে গেলে আমার চোখে জল আসে। মাংস আর ঝোল নন-কো-অপারেশন করে বসে আছে-এদিকে শক্ত মাংস ওদিকে টলটলে ঝোল। মাংসের নিতান্ত আপন সোওয়াদ আছে বলেই খাওয়া যায়, কিন্তু আসলে অখাদ্য”। একেবারে মিথ্যে নয় কথাটা। বাঙ্গালি তো মোগল পাঠান নয় যে রুখাশুখা দেশের মানুষ, নদীমাতৃক দেশের মানুষের খাবারের থালাও তাই জল থৈ থৈ করে! তাতে জাফরান, কাজু, কিশমিশ, আলুবোখারার মত উমদা চিজ নেই। তবে বেঁচে থাকলে সৈয়দ সাহেব নিশ্চয়ই মেজবানি মাংসের সুখ্যাতি শুনে চট্টগ্রামে আসতেন এবং তার ভুলটা বোধহয় ভেঙ্গেই যেত। কারণ মেজবানি মাংসটা নাক এবং জিভের সঙ্গে এমন কো-অপারেশন করে যে যে খেতে খেতে একটা সময় মন আরো চাইলেও পেট আর কুলিয়ে উঠতে পারে না!

 

মাছে ভাতে বাঙ্গালি হলেও উৎসবে পার্বনে মাংস ছাড়া যেন চলেই না। বিয়ের ভোজ থেকে কুলখানি, বাঙালি মুসলমান পরিবারের আয়োজনে মাংস থাকবেই এবং মাংস মানে গরুর মাংস। কখানা গরু জবাই হল, তা দিয়েই যেন আয়োজনের বিশালত্ব মাপা! মেজবান চট্টগ্রামের আঞ্চলিক আয়োজন হলেও এখন বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই মেজবান আয়োজনের প্রচলন শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় “মেজ্জান” নামে পরিচিত এই ভোজ আয়োজন করা হয়ে থাকে আকিকা, সুন্নতে খতনা, পূর্বপুরুষের মৃত্যুবার্ষিকী, সাফল্য উদযাপন সহ বিভিন্ন উপলক্ষ্যে।
মেজবানের বিশেষত্ব হচ্ছে বিশালত্বে। সাধারণ বিয়েশাদীতে না হয় সর্বোচ্চ হাজার দুয়েক লোকের সমাগম হয়, যে কোন মেজবানেও সংখ্যাটা হয় এর দুই থেকে তিনগুণ! ৪৭০টি বিরাট গরু, প্রায় ৩০০০ মন গরুর মাংস দিয়ে ৬-৭ লক্ষ মানুষের খাবারের আয়োজনও হয়েছে একটি মেজবানে । চট্টগ্রামের আবুল হোসেন বাবুর্চি এই পেশায় আছেন বাবার দেখানো পথে, ৩০/৩৫ বছর ধরে রান্না করছেন তিনি।তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আছে একে খান গ্রুপের আনুমানিক বিশ হাজার মানুষের জন্য মেজবান। আরও আছে বোয়ালখালির মাঝির মেজবান যেখানে তিনি প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের জন্য মেজবানের রান্না করেছিলেন।
উপলক্ষ্য যাই হোক না কেন, মূল আয়োজনটা হচ্ছে খাওয়া দাওয়ার। বিয়ের ভোজের মত পোলাও বিরিয়ানি নয়, মেজবানের খাবারের মূল অনুসংগ হচ্ছে মাংস আর ভাত। সঙ্গে বুটের ডাল দিয়ে গরুর মাথা-চর্বি-হাড় আর গরুর পায়ের হাড়ের ঝোল এই হচ্ছে মেজবানের মেনু। অতিথি সবার জন্যই একই আয়োজন।পরিমানে অফুরান, নেই কোন বেঁধে দেয়া পরিমান। মেজবানে নিমন্ত্রিত অতিথিরা এসে যত খুশি তত খেয়ে যাবেন, এতেই আয়োজকদের পরিতৃপ্তি। সেই মেজবানেই যে মাংসের তরকারিটা রান্না করা হয়, সেটাই পরিচিতি পেয়েছে মেজবানি মাংস নামে। চট্টগ্রামে মেজবানের জন্য প্রসিদ্ধ বাবুর্র্চিরাই বেশিরভাগ সময় ঢাকায় বা অন্য কোথাও মেজবানের আয়োজনের রান্না করে থাকেন। অনেক রেস্তোরাতেও পাওয়া যায় মেজবানি মাংস, বাংলাদেশের অন্যতম বড় খাদ্যপন্য প্রস্তুতকারী সংস্থা এসিআই বাজারে এনেছে মেজবানি মাংসের রেডি মিক্স মশলাও। তবুও বেশিরভাগ মানুষেরই একটাই কথা, আসল মেজবানের স্বাদ রেডি মিক্স মশলায় আর রেেেস্তারায় পাওয়া যায় না।
তাহলে কি সেই গোপন রহস্য? বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার এবং চট্টগ্রামের দম ফুঁক রেস্তোরার অংশীদার নাফিস ইকবাল জানালেন কিছুটা, “ আসলে মেজবান রান্না হয় অনেকের জন্য। রান্নাটা হয় লাকড়ির চুলায়। এইজন্যই হয়তো মেজবানের মাংসের আলাদা একটা স্বাদ”। মেজবানি মাংসের রেসিপিতে আসলে বাড়ির সাধারণ মাংস রান্নার চাইতে আলাদা কিছু মশলা করা হয় আর রান্নাটা লাকড়ির চুলায় হয় বলেই স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণে। কয়েকজন বাবুচিঁর কাছেই শোনা, মেজবানি মাংস রান্নার হাঁড়ি এবং চুলাও নাকি আলাদা! একজন তো গোমর ফাঁস করতে রাজিই হলেন না, “জীবনে বহুত কষ্ট করছি, বুঝছেন। তারপর এই মেজবানি রান্না শিখছি। এখন কপাল ফিরছে। গরুর গোশ, নলা, সব রান্না পারি।’
জাদুকররা যেভাবে তাদের গোপন রহস্য সামনে আনেন না, সেভাবেই হয়তো চট্টগ্রামের মেজবানের বাবুর্চিরাও নিজেদের ‘বিজনেস ট্রিক’ গোপন রাখতেই পছন্দ করেন। যদিও অনেকেই জানিয়েছেন যে তারা আস্ত জিরা, সাদা সরিষা, ধনিয়া, মৌরি, শুকনা মরিচ, মেথি, জয়ত্রী, জয়ফল, পোস্তদানা ইত্যাদি মশলার ব্যবহার করেন; হাটহাজারির বিশেষ জাতের মরিচও নাকি ব্যবহার করা হয় যেটা তরকারিতে রঙ আনলেও ঝাল করে না। ইন্টারনেট দুনিয়ায় অনেক রেসিপিই আছে মেজবানি মাংসের, সেগুলো অনুসরণ করে রান্না করে দেখাও যেতে পারে। তবে সেটা অনেকটাই হবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত। কারণ টাটকা মাংস পাটায় পেশা মশলায় কষিয়ে লাকড়ির আগুনে তামার পাতিলে রান্না করলে তবেই খুলবে মেজবানি মাংসের স্বাদ!


মেজবানি মাংস খেলেও হয়তো মুজতবা আলীর চোখে চল গড়াত, তবে সেটা দুঃখে নয় হয়তো গরমে আর ঝালে। ডেকচি থেকে নামিয়ে আনা আগুন গরম ভাত, এখনো ধোঁয়া উড়ছে। প্লেটে বানানো ছোটখাট ভাতের টিলার উপর ঢেলে দেয়া হল একগাদা মাংস। নানান রকম মশলায় গা ডুবিয়ে তামার চৌবাচ্চায় স্নান করে সুসিদ্ধ হওয়া মাংসের পরতে পরতে ঢুকেছে আদা, রসুনের ঝাঁঝ আর রাঁধুনি, মেথিসহ নানান ভেষজের খোশবাই। ঝোলটা মোটেও ঘন থকথকে নয়, আবার একেবারে ট্যালট্যালে পদ্মার পানিও নয়। টকটকে লাল, তার থেকে আসছে কাঁচা মরিচের সুঘ্রাণ আর সরষের ঝাঁঝ। নেই আলুর অহেতুক উপস্থিতি। অনেক মানুষের সমাগম, এমনিতেই গরম তার উপর কাছেই অস্থায়ী রান্নাঘর। এমন গরমের ভেতর আগুন গরম ভাতে টকটকে লাল ঝোল মেখে মাংসের টুকরাটা ভাতের ভেতর সেঁধিয়ে একেকটা গ্রাস বানিয়ে মুখে পুরছেন। সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজে একটা কামড় কিংবা কাঁচা মরিচে। কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, হয়তো ঘোলা হয়ে উঠছে চশমার কাঁচ। এই অভিজ্ঞতা না হলে মেজবানের মাংসের আসল স্বাদ টের পাওয়া যাবে না।
বাড়ির বড় মেয়ে যদি একেবারে সর্বগুণে গুনান্বিতা হয়,তাহলে মেজ আর ছোটর দিকে কেউ যেন ফিরেও তাকায় না! মেজবানের মাংসের সুখ্যাতিতে সেভাবেই আড়ালে চলে গেছে হাড়-চর্বি-মাথা দিয়ে রান্না করা বুটের ডাল আর গরুর পায়ের মোটা হাড়ের ঝোল নলাকাঞ্জির কদরও। অথচ স্বাদ মোটেও কম নয় এই দুটো পদেরও। চর্বি গলে বুটের ডালের সঙ্গে তৈরি করে দারুণ এক সুগন্ধ, আর ডালের মাঝে ছোট ছোট হাড় কিংবা কলিজার টুকরো গোটা খাবারের অভিজ্ঞতাটাকেই এক ধাপ বাড়িয়ে দেয়। ভাত খাওয়ার পালা শেষে নলার হাড়টা মুখে পুরে মজ্জার জন্য চুষতে থাকার মজাই আলাদা, সেই সঙ্গে হালকা টকস্বাদের ঝোলটা যেন বাড়তি পাওয়া।
অনেক মেজবানে অবশ্য ইদানিং গরুর মাংসের কালাভুনাও পরিবেশন করা হয়। হাড়বিহীন মাংস নানান মশলায় রান্না করে হাড়িতে নেড়ে নেড়ে ঝোল একেবারে শুকিয়ে ফেলা এই মাংসের পদটা নাকি মেজবানের ঐতিহ্যবাহী পদ নয় বলেই জানালেন নাফিস। কালাভুনাটা আলাদা একটা পদ, যেটা নাফিসদের পারিবারিক ব্যবসা চট্টগ্রামের খোয়াজা রেস্টুরেন্টে বেশ দারুণ হয় বলেই জানিয়েছেন তামিম ইকবালের বড় ভাই আর আকরাম খানের ভাইপো।
সিলেটের আছে সাতকড়া মাংস, খুলনা যশোর অঞ্চলের আছে চুই ঝালে মাংস, তেমনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাবার বলতেই সবার আগে চলে আসে মেজবানি মাংসের নাম। দেশবিদেশ ঘুরে নানান পদের খাবার খেয়ে বেড়ানো “ফুড রেঞ্জার” ট্রেভর জেমস, “বেস্ট এভার ফুড রিভিউ শো”এর সনি সাইড এমনকি বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুড ব্লগার আদনান ফারুকও তাদের ইউটিউব চ্যানেলে দেখিয়েছেন মেজবান আয়োজনের বিশাল কর্মযজ্ঞ আর মুগ্ধ হয়েছেন মেজবানি মাংসের অতুলনীয় স্বাদে।
মুজতবা আলী আক্ষেপ করেই লিখেছিলেন;
“একেবারে কেউই পারে না এ কথা বলব না। ঢাকার নবাব-বাড়ি,সিলেটের কাজী-বাড়ি এবং মজুমদার বাড়ি (শুনেছি-খাইনি কখনো), মুর্শিদাবাদ ও মেটিয়াবুরুজের নবাব বাড়িতে এসব বস্তু সত্যই ভাল রাঁধেন।’ ওপার থেকে দেখার ব্যবস্থা থাকলে সৈয়দ সাহেব নিশ্চয়ই দেখছেন, গোরা সাহেবরা এসে এখন খোদ বাংলাদেশে চট্টগ্রামের মেজবানি বাবুর্চিদের হাতের মাংস রান্না খেয়ে রীতিমত আঙ্গুল চাটছেন!

Share it in social media


আরও খবর