সাফল্যে গাঁথা এক শেফের জীবন
মোদাচ্ছির আহমদ

 

শেফ মোদাচ্ছির আহমদ বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনা করছেন দু’টি, বিজনেস পার্টনারকে নিয়ে।ব্যবসা প্রসারেরও চিন্তাভাবনা করছেন। আরেকটি নতুন রেষ্টুরেন্ট বা টেকওয়ে খোলার চেষ্টা করছেন। কারি ইন্ডাষ্ট্রীতে কাজ শুরুর প্রথম দিকে মোটেই ভাল লাগেনি কিচেনের কাজ। বললেন, এটা ছিল হার্ড ওয়ার্ক, এজন্যে অনেকটা ঘৃণাই করেছেন শুরুতে। এখন আর ঘৃণা নয় গর্বিত মনে করেন নিজেকে। বাংলাদেশে থাকতে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাবার গ্রোসারী ব্যবসা চালাতেন। সিলেটের স্টেশন রোডে অবস্থিত গ্রোসারী দোকান সানি এ্যান্ড সন্স। সুখের ও আনন্দের দিন ছিল তখন। তেমনটি কষ্ট করতে হতোনা। দোকানে লোকজন ছিল বেশ। আর বিলেতে এসে বুঝলেন কঠোর বস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতাও উপলব্দি করতে পেরেছেন, এখানে কষ্ট করলে এবং লক্ষ্য স্থির থাকলে সফল হওয়া যায়, গন্তব্যে পৗছানো যায় সহজে। প্রথম দিকে অনেক কষ্টের মনে করেছিলেন রেষ্টুরেন্টের কাজ। বিলেতে আসার পরে আত্মীয় স্বজনের পরামর্শে রেষ্টুরেন্টে কাজ ধরলেন কিচেনে। ভাল শেফ হতে পারলে আর্থিক বেনিফিটটা বেশি। এছাড়া প্রথম দিকে সেটি বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি এই পেশায় সুনামও অর্জন করা যায়। আর সবসময়ই ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে এই জবের বিরাট চাহিদা রয়েছে। তাই একই রেষ্টুরেন্টে টানা ১০ বছর কাজ করেছেন। এখন নিজের ব্যবসা চালাচ্ছেন। বাংলাদেশেও পারিবারিক সূত্রে পাওয়া ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। ব্যবসা পরিচালনা যতটুকু কষ্টের এরচেয়েও বেশি কষ্টের মনে করেছিলেন প্রথম দিকে রেষ্টুরেন্টের কাজ। এখন শুধু একটি ব্যবসা সফল টেকওয়ে নয়, একটি ফিশ এ্যান্ড চীপসের মালিকও শেফ মোদাচ্ছির। এখন আর শেফ হিসাবে তার কোন আফসোস নেই। বিভিন্ন রেষ্টুরেন্ট ও টেকওয়েতে ২৫ বছর কাজ করে যে দক্ষতা অর্জন করেছেন এর জন্য গর্ববোধ করেন শেফ মোদাচ্ছির। গত দশ বছর থেকে বার্মিংহ্যামের গ্রেট বারে তার টেকওয়ে, নাম শিকাস। এর আগে একযুগ কাটিয়েছেন কাজ করে শেফ হিসাবে আরেকটি বিখ্যাত রেষ্টুরেন্টে। শ্রপশায়ারের ব্রিজনর্থে অবস্থিত ইউরেশিয়া রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন তিনি। ইউরেশিয়া ঐ শহরের অন্যতম পুরাতন ব্যবসা যা প্রতিষ্টিত হয়েছে প্রায় ৪৫ বছর আগে। শেফ মোদাচ্ছির জানান, খুব ব্যস্ত এই রেষ্টুরেন্টই তার বড় অন্যতম ট্রেনিং গ্রাউন্ড হিসাবে কাজ করেছে। এখন ব্যবসা ম্যানেজ করছেন পার্টনার জুবেদ হককে নিয়ে, সুন্দরভাবে। তিনি বলেন, সবগুলো ব্যবসাই তুই পার্টনারের এবং আগামীগুলোও তারা একত্রে করবেন।
১৯৯৬ সালে ২৪/২৫ বছরের যুবক মোদাচিছর সিলেটের ব্যবসা পিছনে ফেলে বিলেতে পাড়ি জমান। শীতকাল, বার্মিংহ্যামে এসেই মনে হয়েছে অদ্ভুত এক আবহাওয়া। সেখানে পৌছানোর পরে রেষ্টুরেন্টে কাজ শুরুর পূর্বে এক মাস ঘুরে বেড়ান লন্ডন ও সাউথের বিভিন্ন শহরে নিজের আত্মীয় স্বজনের সাথে সাক্ষাত করে। এক মাস পরে কাজে যোগ দিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন মোদাচ্ছির। ওয়ারউইকে পরিচিত এক বন্ধুর ক্যাসল বাল্টি নামের রেষ্টুরেন্টে কিচেন পোর্টরের কাজ শুরু করেন তিনি। অন্য অনেক মানুষের মতো মোদাচ্ছিরও মনে করেন এ কাজ তার পক্ষে সম্ভব হবে না। বছরের মাথায়ই সেখান থেকে চলে যান। আরেকটি টেকওয়েতে গিয়ে কাজ ধরেন। বালটি কিচেন নামের ঐ টেকওয়েও বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি তাকে। মাত্র সাত মাসের মাথায় কাজ পরিবর্র্তন করেন আবার। প্রথমে কিচেন পোর্টার, তারপর কুক, এর পরে তান্দুরী শেফ এভাবে দফায় দফায় অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে তার। ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে, কাজ পরিবর্তনের ফাকে ভাবতে থাকেন, নিজের ব্যবসা করতে হবে। যখন শেফ হিসাবে নিজেকে একদম পাক্কা করে ফেলেছেন তখন ২০১০ সালে শিকাস টেকওয়ে চালু করেন। ফাইভস্টার হাইজিং রেটিং সম্পন্ন শিকাস এওয়ার্ড বিজয়ি এবং এখন খুবই ব্যস্ত ব্যবসা।
এক পর্যায়ে ভিন্ন কিছু করার নেশায় পেয়ে যায় মোদাচ্ছির আহমদকে। মোদাচ্ছির কারি শেফ এর গন্ডি পেরিয়ে খোলেন একটি ফিশ এ্যান্ড চিপস এর দোকান। নতুন ট্রেড তাকে এই খাবার সম্পর্কেও জানতে হবে। কিভাবে ফ্রেশ ফিস তৈরি করে কাস্টমারদের মন জয় করতে হবে সেদিকে নজর দেন তিনি। এখন ফাষ্টফুড শপের অভাব নেই। কিন্তু খাবারের যেকোন ধরণের দোকানই হোক, কাস্টমারের পেট জয় করতে পারলে আপনার ব্যবসা সফল হবে বলেন মোদাচ্ছির। ভাল ফিশ এ্যান্ড চিপস তৈরিতেও তার হাতে যাদু আছে। শীঘ্রই আরও একটি ব্যবসা করছেন তিনি।
ব্যবসা হিসাবে ফিশ এ্যান্ড চিপস না ইন্ডিয়ান টেকওয়ে বেশি লাভজনক? এই প্রশ্নের জবাবে একটু ভাবিয়ে তুলে শেফ মোদাচ্ছিরকে। অনেকটা ভেবে চিন্তে উত্তর দেন তিনি। বলেন, দুটি দুধরণের ব্যবসা। আমি বলবো ফিশ এ্যান্ড চিপসে মুনাফা বেশি। কিন্তু সেখানে ক্রিয়েটিভিটি নেই। আপনি যে করিৎকর্মা একজন শেফ সেটা দেখানোর কোন সুযোগই নেই। স্পাইস ও প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে আপনি সবশেষে যে খাবার প্রদর্শন ও পরিবেশন করবেন সেটার তৃপ্তিই আলাদা। তিনি বলেন, আপনাকে হয়তো সমপরিমাণ মুনাফার জন্য কাজ করতে হবে একটু বেশি। তবে ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টের শেফ ও ফিশ এ্যান্ড চিপসের শেফ এর মর্যাদার মধ্যেতো তফাৎ আছে। মোদচ্ছির জানান টিপটনে তার ফিশ এ্যান্ড চিপস শপে তারা কিছু ইন্ডিয়ান খাবার যেমন, টিক্কা, নান ইত্যাদিও মেন্যুতে সংযুক্ত করেছেন।
শেফ মোদাচ্ছির জানান, শিকাস টেকওয়ে তার এলাকায় খুবই জনপ্রিয়। ভাল খাবারের জন্য বিগত ১০ বছরে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। স্থানীয় মিডিয়াতে এর রিভিউ বেরিয়েছে। টেকওয়েতে পার্ট টাইম ফুলটাইম, ড্রাইভার মিলে প্রায় এক ডজন স্টাফ তাদের।
পারিবারিকভাবে ২ ছেলে ও এক মেয়ের জনক শেফ মোদাচ্ছির। স্ত্রী বাচ্চাদেরকে দেখাশোনা করেন। বড় ছেলে বার্মিংহ্যাম ইউনিভার্সিটিতে লেখা পড়া করছে। উইকেন্ডে মাঝে মাঝে ব্যবসায় তাকে সাহায্য করে। এদের নিয়ে এবং ব্যবসার সবাইকে নিয়েই তার সুখের সংসার জানালেন মোদাচ্ছির।

Share it in social media


আরও খবর